পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:)

164

কে.এম. মিনহাজ উদ্দিন ফেঞ্চুগঞ্জী

সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ তা’য়ালার। অগণিত দরূদ ও সালাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। আল্লাহর অসীম দয়াতে প্রতি বছরের ন্যায় আবারও ফিরে এসেছে আমাদের নিকট পবিত্র রবিউল আউয়াল মাস, রহমতের মাস, বরকতের মাস, ফজিলতের মাস, শান্তির মাস, খুশির মাস, মানব জাতির ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক মাসই হচ্ছে রবিউল আউয়াল মাস। এ মাসের ১২ তারিখ হচ্ছে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:)। এ মাসে এদিনই পৃথিবীতে শুভাগমন করেন আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত, সাইয়্যিদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামীন খাতামুন নাবিয়ীন, শাফীউল মুজনিবীন, নূরে মুজাসসাম, মানব জাতির একমাত্র মুক্তিদাতা, একমাত্র পথ প্রদর্শক হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা:)। মহিমা মন্ডিত এ মাস ও দিনটি প্রতি বছর সমগ্র পৃথিবীর আনাচে-কানাচে মুসলিম উম্মাহ আনন্দ উৎফুল্ল চিত্তে পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। আমাদের বাংলাদেশেও রয়েছে তার সমৃদ্ধশালী অতীত ইতিহাস। মুসলিম মিল্লাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ দিবসটি সারা বিশ্বে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) হিসেবে উদযাপিত হয়। মহানবী (সা:) এর শুভাগমন হচ্ছে মহান আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত ও রহমত। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন নিয়ামত পেলে সে নিয়ামত ও রহমতের কথা স্মরণ করে ঈদ হিসেবে উদযাপন করার জন্য মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআন মজীদে ইরশাদ করেন ‘হে নবী আপনি মানব জাতিকে বলে দিন আল্লাহর ফজল ও রহমত প্রাপ্তিতে তাদের খুশী করা বা ঈদ উদযাপন করা উচিত।’ সূরা ইউনুছ : আয়াত ৫৮। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী (রহ:) বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর আদদুরুল মনসুরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন, এখানে আল্লাহর অনুগ্রহ ‘ইলম’ আর রহমত দ্বারা মহানবী (সা:)কে বুঝানো হয়েছে। রাসূল (সা:) এর মীলাদকে আল্লাহ পাক আরও স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে আগমন করেছেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসূল যার নিকট তোমাদের দুঃখ কষ্ট দুঃসহ যিনি তোমাদের অতিশয় হিতাকাঙ্খী, মুমিনদের প্রতি বড়ই স্নেহশীল ও করুণা পরায়ণ’ সূরা আত তাওবা : ১২৮।
মিলাদুন্নবীকে সাহাবায়ে কেরামগণ শুকরিয়া ও আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করতেন। আল্লামা আবুল খাত্তাব উমর ইবনে কালবী (রহ:) রচিত ‘কিতাবুত তানবীর ফি মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর’ এবং হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী (রহ:) রচিত ‘সাবী লুলহুদা ফী মাওলিদিল মুস্তাফা’ গ্রন্থে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু দারদা (রা:) হতে বর্ণিত একদিন রাসূলুল্লাহ (সা:) হযরত আমের আনসারী (রা:) এর ঘরে গমন করে দেখতে পেলেন যে, আবু আমের আনসারী (রা:) তার নিজ সন্তানাদি সহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনকে একত্রিত করে রাসূলুল্লাহ (সা:) এর বেলাদতের বিবরণী শুনাচ্ছেন। তাঁর এ কাজে আল্লাহর রাসূল (সা:) অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করলেন এবং বললেন, হে আমের নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার জন্য তাঁর রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করেছেন। যারা তোমার মত এরূপ আমল করবে তারাও পরিত্রাণ পাবে।
আদ-দুররুল মুনাজ্জম ও সাবিলুল হুদা ফী মাওলিদিল মুস্তফা এবং মওলুদে কবীর গ্রন্থে বর্ণিত একদিন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) তাঁর ঘরে জনগণকে সমবেত করে রাসূল (সা:) এর বেলাদতের কাহিনী বর্ণনা করছিলেন যা শ্রবণে উপস্থিত সকলেই আনন্দাপ্লুত হয়ে হুজুর (সা:) এর উপর দরূদ ও সালাম প্রেরণ করছিলেন, এমন সময় নবী করীম (সা:) তথায় উপস্থিত হয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমাদের জন্য আমার শাফায়াত অবধারিত হয়ে গেল।
আল্লামা শিহাবুদ্দীন আহমদ বিন হাজরুল হায়তমী শাফী (র:) তার প্রণীত ‘আন্নিয়ামাতুল কুবরা আলাল আলম ফি মাওলিদি ছাইয়্যিদি ওয়ালাদি আদম’ নামক কিতাবে উল্লেখ করেন- মুসলিম বিশ্বের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা:) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হুজুর (সা:) এর মিলাদ শরীফে একটি মাত্র দিরহাম ব্যয় করবে, কিয়ামতের দিন সে আমার সাথী হয়ে বেহেশতে থাকবে’। মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা:) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হুজুর (সা:) এর মিলাদকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছে সে যেন ইসলামকে পুন:জীবিত করল’। মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা:) বলেন, “যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী (সা:) উদযাপনে একটি মাত্র দিরহাম ব্যয় করবে, সে যেন বদর হুনাইনের মত মহান যুদ্ধে অংশগ্রহন করল’’। মুসলিম বিশ্বের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা:) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) উদযাপন করবে ঐ ব্যক্তির ঈমানের সাথে মৃত্যু হবে এবং কোন প্রকার জিজ্ঞাসা ব্যতিত জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
হযরত ইমাম শাফী (রহ:) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী (সা:) উদযাপন করবে, কিয়ামত দিবসে আল্লাহ পাক ঐ ব্যক্তিকে সত্যবাদী, নেককার, শহীদদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’।
হযরত হাসান বসরী (রহ:) বলেন, যদি আমার নিকট ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকতো তবে তাও আমি নবী করীম (সা:) এর মিলাদ উপলক্ষে খরচ করতাম।
ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ: বলেন, যে কোন ব্যক্তি সামান্য লবণ, গম বা অন্য কোন খাদ্যবস্তু নিয়ে মিলাদ পাঠ করবে নিশ্চয় তাতে এবং তদসংশ্লিষ্ট সব কিছুতে বরকত হবে। কেননা সে খাবার ততক্ষণ পর্যন্ত অস্তিরতায় থাকে যতক্ষণ না আল্লাহ তায়ালা তার ভক্ষকের গোনাহ ক্ষমা করেন। যদি পানির উপর মিলাদ পাঠ করা হয়, আর সে পানি যদি কেউ পান করে তবে তার অন্তরে এক হাজার নূর ও রহমত প্রবেশ করবে, তার অন্তর থেকে এক হাজার বিদ্বেষ, রোগ ও সংকীর্ণতা দূরীভূত হয়ে যায় আর সে অন্তর সেদিন মৃত্যুবরণ করবে না যেদিন বহু অন্তরের মৃত্য হবে।
বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দেস হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহলবী (রহ:) তাঁর বিখ্যাত কিতাব ‘মাছাবাতা বিচ্ছুন্নাহ উল্লেখ করেন মিলাদুন্নবী (সা:) এর রাত্রি শবে কদরের রাত্রি থেকে নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্ট, কেননা মিলাদুন্নবী (সা:) এর রাত্রি স্বয়ং প্রিয় নবীর আগমনের রাত্রি। আর শবে কদর তো তাকেই প্রদান করা হয়েছে। হযরত আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহলবী (রহ:) তাঁর বিখ্যাত কিতাব মাদারেজুন নবুয়াতে বলেন, পাল্লার এক পাশে যদি দুই ঈদকে রাখা হয়, আর পাল্লার অপর পাশে নবীর আগমনের ঈদকে রাখা হয়, তাহলে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) এর পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। কেননা, এ দুই ঈদ আমরা পেতাম না, যদি আল্লাহর নবী না আসতেন সুতরাং এই দিন উম্মতের জন্য ঈদ নয় কি? যদি দুই ঈদে এত বেশী খুশি উদযাপন করা যায়। তাহলে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) তে আর বেশী খুশি উদযাপন করা যায় না কি? হযরত জুনাইদ বোগদাদী (রহ:) বলেন, যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী (সা:) মাহফিলে হাজির হয় এবং তাঁর মর্যাদাকে প্রাধান্য দেয় সে ব্যক্তিই সফল ঈমানদার।
আল্লামা ইমাম জালাল উদ্দিন সূয়ূতী (রহ.) ‘আল ওসায়িলু ফি সারহিছছামায়িল’ গ্রন্থে বলেছেন, যে কোন গৃহে বা মসজিদে অথবা মহল্লাতে মিলাদ পাঠ করে আল্লাহ পাকের ফেরেশতা ঐ স্থানকে বেষ্টন করত: ঐ স্থানে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে তাদের জন্য ইসতেগফার করতে থাকে। মহান আল্লাহর রহমত ও রেজামন্দী ব্যাপকভাবে তাদের উপর নাযিল হতে থাকে। আর যে সমস্ত ফেরেশতারা নূর নিয়ে মজলিসে প্রদক্ষিণ করে অর্থাৎ জিব্রাঈল, মীকাঈল, ইস্রাফীল, আজরাঈল (আ:) তাঁরা ঐ মজলিসের আহ্বায়কদের জন্য দু’আ করতে থাকেন। উক্ত গ্রন্থে তিনি আরো বলেন, যে কোন মুসলমান নিজ গৃহে মিলাদুন্নবী পাঠ করবে ঐ ঘর হতে মহান আল্লাহ তা’য়ালা অভাব-অনটন, বালা-মুসীবত, অগ্নিজলন, পানিতে নিমগ্ন, যাবতীয় মুসীবত ও হিংসা,হাসাদ, কুদৃষ্টি, চোর-ডাকাত হতে মুক্ত রাখবেন। যখন সে মত্যুবরণ করবে মুনকার-নাকীর ফেরেশতার প্রশ্নোত্তর তার জন্য সহজ করে দেওয়া হবে এবং সে পরম সুখে বেহেশতবাসী হবে। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) ‘ফয়সালায়ে হাপ্ত মাসায়েল’ কিতাবে বলেছেন, আমার নীতি হচ্ছে আমি মীলাদ মাহফিলে যোগদান করি বরং একে বরকাতের ওসীলা মনে করে আমি নিজেই প্রতি বছর এর আয়োজন করে থাকি এবং কিয়ামে আনন্দ ও তৃপ্তি পেয়ে থাকি।’’
হযরত সিররী সাকাতী (রহ.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন মিলাদ মাহফিলে যোগদান করার ইচ্ছা করলো, সে যেন বেহেশতের বাগানে যাওয়ার ইচ্ছা করলো। কেননা লোকটি হুজুর (সা:) এর মহব্বতের কারণেই ঐ মাহফিলে যোগদান করতে যাচ্ছে। হাদীস শরীফে এসেছে, যে আমাকে ভালবাসবে সে আমার সহিত বেহেশতে থাকবে।
ইমাম গাজ্জালী (রহ:) ‘মুনফেজ মিনাদ্দালাল’ কিতাবে উল্লেখ করেন, নিশ্চয়ই তরিকতপন্থী লোকগণ মিলাদুন্নবী (সা:) এর মাহফিলে জাগ্রত অবস্থায় ফেরেস্তা ও নবীগণের রূহের সঙ্গে সাক্ষাত করে থাকেন। তাই ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) উদ্যাপন করা এবং রবিউল আউয়াল মাসে দান খয়রাত করার ফজিলত অনেক। যাকে সৃষ্টি না করা হলে কোন কিছুই সৃষ্টি করা হত না তাঁর সেই পবিত্র জন্মদিনের চেয়ে খুশির দিন সৃষ্টিকূলের জন্য আর কোনটিই হতে পারে না। মহানবী (সা:) এর পবিত্র জন্মদিনই তামাম দুনিয়ার সৃষ্টির জন্য এক বিরাট নিয়ামত প্রাপ্তির দিন, মহাখুশির দিন, সর্বোত্তম ঈদের দিন, সেই দিন তামাম মাখলুকাত খুশি জাহির করেছিল কিন্তু দুঃখিত হয়েছিল সেইদিন ইবলিস শয়তান।
সুয়াইবা ছিলেন আবু লাহাবের আজাদকৃত দাসী। সে আবু লাহাবকে নবী করীম (সা:) এর জন্ম সংবাদ দিয়েছিল। সেই আবু লাহাব ভাতিজার জন্ম সংবাদে খুশি হয়ে শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে সুয়াইবাকে মুক্তি দিয়েছিল। আবু লাহাবের মৃত্যুর পর হযরত আব্বাস (রা:) তাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করলেন আপনার অবস্থা কেমন? সে জবাবে বলল তোমাদেরকে ছেড়ে আসার পর আমার কল্যাণজনক কিছুই হয়নি। তবে এই শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে সুয়াইবাকে ইশারা করে মুক্তি দেয়ার কারণে আমাকে এই আঙ্গুল দিয়ে পানীয় দেয়া হয় যার ফলে আমি প্রচুর স্বাদ উপভোগ করি (বুখারী ২য় খন্ড ঃ পৃষ্ঠা-৭৬৪)। একজন কাফের যার উপর অভিসম্পাত করে পবিত্র কোরআনের সূরা ‘লাহাব’ নাজিল হয়েছে। এমন কট্টর কাফের আবু লাহাবও যদি নবীর জন্মদিনে খুশি প্রকাশ করায় পুরস্কৃত হল। তাহলে আমরা নবী করীম (সা:) প্রাণপ্রিয় উম্মত হয়ে নবীর জন্মদিনে আনন্দিত হয়ে যদি ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) পালন করি এবং নবী করীম (সা:)-এর উপর সালাত ও সালাম পাঠ করি তাহলে যে আমরা কত উপকৃত হব তাতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের প্রিয় নবী (সা:) এর আদর্শ অনুসরণ, অনুকরণ ও সমাজে তা বাস্তবায়নের তাওফিক দিন (আমীন)।