ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ॥ রাজনীতি এখন হয়ে গেছে ‘গরীবের ভাবি’র মতো

237

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বৈবাহিক জীবনের বয়সের হিসাব তো বছর দিয়েই করা হয়, তাই না? তবে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সে হিসাব কষেছেন সেকেন্ডের হিসাবে। আর সে হিসাব তিনি তুলে ধরার পর পড়ে গেল হাসির রোল।
শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১ তম সমাবর্তনে গুরুগম্ভীর আলোচনার পাশাপাশি রসিকতায় পরিপূর্ণ বক্তব্যে শিক্ষার্থীদের জন্য পুরো অনুষ্ঠানটিকেই উপভোগ্য করে তুলেছেন রাষ্ট্রপতি। বক্তব্যের মধ্যে তুমুল হাততালি আর হাসাহাসিতে অবশ্য মাঝে তাকেও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকতে হয়েছে।
বিয়েটা তুলনামূলক অল্প বয়সে করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। সেই হিসাব তুলে ধরে সমাবর্তনে বলেন, ‘আমার বিয়ের বয়স এক কোটি ৭০ লক্ষ ২৯২ হাজার সেকেন্ড!’
এমন হিসাব কে কখন শুনেছে? তাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের মতো অনুষ্ঠানে? যা হওয়ার তাই হয়েছে, সজোরে হাসার পাশাপাশি পড়ে তুমুল হাততালি।
বিশ্বসুন্দরী প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গে দেখা না হওয়ার আক্ষেপে পুড়ছেন রাষ্ট্রপতি। তার সঙ্গে গাঁটছড়া যদি বাঁধা যেত, সেই কামনাও রয়েছে তার।
বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের দেখতে ভারতীয় নায়িকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়া যখন বাংলাদেশে আসেন, তখন আমি মনে করেছিলাম সে বঙ্গভবনেও আসবে এবং আসাটাই ছিল স্বাভাবিক।’
কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ান রাষ্ট্রপতি ‘বেরসিক স্ত্রী’। সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম (প্রিয়াঙ্কার কথা)। কিন্তু পরে আমার স্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে বলেন, প্রিয়াঙ্কার বঙ্গভবনে আসার কী দরকার? ফলে সে আর আসেনি কিন্তু পরে জানতে পারি সে সুদূর আমেরিকায় গিয়ে তার চেয়ে ১২ বছরের ছোট ‘নিক’ নামে এক ছেলেকে বিবাহ করেছে।’
আক্ষেপ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘যদি সে (প্রিয়াঙ্কা) ১২ বছর নিচে নামতে পারে, তাহলে ৩০-৩৫ বছর উপরেও ওঠতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার সেটা হলো না।’
যেই না রাষ্ট্রপতি এই কথা বললেন, হাসি আর থামে না। সেই সঙ্গে চলতে থাকে হাততালি।
স্ত্রী যেন এই ধরনের ‘নির্যাতন’ করতে না পারেন, সে জন্য পুরুষ নির্যাতন আইন কেন নেই, সেটি নিয়েও আফসোস করেন রাষ্ট্রপতি। বলেন, ‘যখন সংসদে আমি স্পিকার ছিলাম তখন নারী নির্যাতন আইন পাস হয়। আইনটি পাস হওয়ার পর আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, নারী নির্যাতন আইন তো করলেন, পুরুষ নির্যাতন আইন কবে করবেন? কারণ শুধু আমার ঘরে নয়, সবার ঘরে একই সমস্যা হচ্ছে।’
“তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দেখা যাক প্রয়োজন হলে পরে করব’। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু আইনটি এখনো হলো না’।
প্রেম সাহিত্যের ‘অধোঃগতি’ নিয়ে চিন্তিত রাষ্ট্রপতি। বলেন, ‘আগে আমরা প্রেমিকাকে প্রেমপত্র লিখতাম, আমি নিজেও লিখেছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু বর্তমান সময়ের তরুণ তরুণীরা এত বেশি ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে গেছে যে তারা সব কাজ মোবাইলে করে। চিঠির আর প্রয়োজন হয় না। ফলে প্রেম সাহিত্য মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। এই সাহিত্যেকে টিকিয়ে রাখতে হলে, মোবাইলের ব্যবহার কমিয়ে আমাদের প্রেমপত্র লিখতে হবে।’
এই হাস্যরসের মধ্যেই অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে গেলেন রাষ্ট্রপতি। রাজনীতির বর্তমান হাল তার ভালো লাগছে না, সেটা জানিয়ে দেন সরাসরি।
কিশোরগঞ্জে জনপ্রিয় প্রবাদ ‘গবিরের বউ সবার ভাউস (ভাবি)’- উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি এর সঙ্গে তুলনা করেন বর্তমান রাজনীতির। চাইলে যে কেউ যেকোন সময়ে এই রাজনীতিতে চলে আসে, সেটা পছন্দ নয় তার। আর বলেন, রাজনীতি এখন গরিবের ভাউসের মতো হয়ে গেছে। যে কেউ চাইলেই রাজনীতিতে আসতে পারছে। কিন্তু অন্য পেশায় কেউ চাইলেই যেতে পারে না।
‘অবসর গ্রহণের পর দেশের ডাক্তার, পুলিশ সবাই নিজেদের রাজনীতিবিদ বলে পরিচয় দেন। সারাজীবন রাজনীতি করবে না, আর নির্বাচনের সময় দলে প্রবেশ করে এমপি-মন্ত্রী হয়ে যাবে। মনে হয় যেন আকাশ থেকে পড়ল।’
‘চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা আছে, কিন্তু রাজনীতিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে তা নেই। যখন ইচ্ছা যে কেউ চাইলেই রাজনীতিতে প্রবেশ করতে পারে। এজন্য চাকরিজীবীরা অবসর নিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করছে।’
৫০ তম সমাবর্তনের মতো আজও রাষ্ট্রপতি অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগঠন নির্বাচনের তাগিদ দেন রাষ্ট্রপতি। বলেন, ‘এই নির্বাচন হলে এইসব লোক জীবনের ৬৫, ৬৭, ৬৯ বছরে দলে ঢুকতে পারবে না।’
দেশ গড়ার কাজে নবীন গ্রাজুয়েটদের নেতৃত্ব দিতে হবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘অতীতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের সকল আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতার পর দেশ গড়ার দায়িত্ব অনেকাংশে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করে গেছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি উল্লেখ করে অপ্রয়োজনীয় বা কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শও দেন রাষ্ট্রপতি। তবে এই সংযোজন, বিয়োজন বা সম্প্রসারণ কোনোটাই যেন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা কতিপয় লোকের স্বার্থে না হয় সে বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
ডিপ্লোমা ও সান্ধ্যকালীন কোর্সের নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে বলেও মনে করেন রাষ্ট্রপতি। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের পাশাপাশি স্বাভাবিক লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে কি না ভেবে দেখারও পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, ‘আমি মনে করি, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্র-শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা ভেবে দেখবেন। মনে রাখতে হবে, জনগণের অর্থেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। তাই তাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’
এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২১ হাজার ১১১ জন গ্র্যাজুয়েট সমাবর্তনে অংশ নিয়েছেন, যা ঢাবির ইতিহাসে সর্বাধিক। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কৃতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ৯৬টি স্বর্ণপদক, ৮১ জনকে পিএইচডি এবং ২৭ জনকে এম ফিল ডিগ্রি দেয়া হয়।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের ভেন্যু ছাড়াও সাত কলেজের গ্র্যাজুয়েটদের জন্য ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজে আলাদা দুটি ভেন্যু ছিল। তারা ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে সেখানে বসে সমাবর্তন অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পেরেছেন।
এবার ‘সমাবর্তন বক্তা’ হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান।
উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরীন আহমাদ, প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা)মুহাম্মদ সামাদ, বিভিন্ন অনুষদের ডিনসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) এনামউজ্জামান।