আবারো আর্থিক কেলেংকারির মুখে সিলেট চেম্বার

40

স্টাফ রিপোর্টার :
সমালোচনা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না সিলেট চেম্বারের। ২০০৯ সালে বাণিজ্য মেলা সংক্রান্ত আর্থিক কেলেংকারির দায়ে চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবুও থেমে থাকেনি কতিপয় পরিচালকের ক্ষমতার অপব্যবহার। এরই জের ধরে সিলেট চেম্বারে প্রশাসক নিয়োগ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে দ্বিধাবিভক্ত পরিচালকদের মামলা এবং পাল্টা মামলার পরেও নির্বাচিত পরিষদের মাধ্যমে চলছে সিলেট চেম্বার অব কমার্সের কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে চেম্বারের নির্বাচনে নতুন পরিচালনা পর্ষদ নিযুক্ত হলেও সমালোচনা রয়েছে ঠিক আগের মতোই। বিশেষ করে চলতি বছরের বাণিজ্য মেলায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়োগের পর থেকে খোদ পরিচালকদের মধ্যে এ নিয়ে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিক্ষুব্ধ পরিচালকদের একটি অংশ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টিকে স্বৈরতান্ত্রিক এবং প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি বিগত দিনে সিলেট চেম্বার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কর্তৃক মেলা বাবদ বিরাট অংকের টাকা পেলেও এবার চেম্বারের হিসেবে মাত্র ১০ লক্ষ টাকা জমা দেখানো হয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।
এবার সিলেট চেম্বার মেলা আয়োজনে নিজ মামলার আসামীকেই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়োগ দিয়ে সমালোচনায় আরো এক ধাপ এগিয়ে আসলো। ২০০৯ সালে সিলেট চেম্বার অব কমার্সের উপর আর্থিক কেলেংকারির অভিযোগে ১ কোটি ১০ লাখ টাকার প্রতারণা মামলা রয়েছে। বর্তমানে মামলার তদন্ত কার্যক্রম হাইকোর্টে আবেদনের মাধ্যমে স্থগিত করে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালে একই ভাবে সিলেট চেম্বারের আয়োজনে সিলেট আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় জন্য ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়োগ পায় জেএস এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ৮১ লক্ষ ৫১ হাজার টাকার টেন্ডারের বিপরীতে সিলেট চেম্বার তখন রয়েলিটি বাবদ ২০ লক্ষ টাকা পায়। বাকী ৬১ লক্ষ ৫১ হাজার টাকার হদিস না পেলেও টাকা আদায়ে তৎপরতা নেই সংশ্লিষ্টদের। তৎকালীন চেম্বার প্রশাসক ফারুক মাহমুদ চৌধুরীর দায়িত্বকালীন সময়ে মেলার শর্তভঙ্গ এবং টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তখন মামলা করা হয় অভিযুক্ত ইভেন্ট প্রতিষ্ঠানের উপর। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফারুক মাহমুদ জানান, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাত ও প্রতারণা মামলা রয়েছে। তবে, যেহেতু এখন আমি চেম্বারের সাথে জড়িত নেই, মামলার বর্তমান অবস্থা কিংবা এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য নিয়ে কথা বলতে রাজী নই।
অভিযোগ উঠেছে- ২০১৮ সালের ১৪ তম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাই জেএস এন্টার প্রাইজের সাথে যুক্ত রয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তৎকালীন প্রশাসক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। এবার ম্যানেজমেন্টের নাম পরিবর্তন করে অভিযুক্ত আসামীরাই মণিপুরি তাঁত শিল্প ও জামদানি বেনারসী কল্যাণ ফাউ-েশন নাম ধারণ করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। দাগি ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠানকে কেনো আবারো বাণিজ্য মেলার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিলো- এবিষয়ে খোদ পরিচালকরাই বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাদের দাবি-সিলেট চেম্বারের কতিপয় পরিচালকের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের ফলে ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে ঐতিহ্যবাহি এই প্রতিষ্ঠানের।
২০১০ সালে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে জেএস এন্টার প্রাইজ ৮১ লক্ষ ৫৮ হাজার টাকা এবং ২০১১ সালে মাছুম ইন্টারন্যাশনাল ৫৮ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়োগ হলেও চলতি বছর তা কেনো ৫০ লক্ষ টাকার রয়েলিটিতে নিয়োগ হলো- এমন প্রশ্নের উত্তর জানা নেই একাধিক পরিচালকের। যদিও মেলা উদযাপন কমিটির আহবায়ক ও সিলেট চেম্বারের পরিচালক মুশফিক জায়গিরদার জানিয়েছেন, ৫০ লক্ষ টাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে মনিপুরি তাঁত শিল্প ও জামদানি বেনারসী কল্যাণ ফাউন্ডেশ কে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে, নিকটতম দরদাতা প্রতিষ্ঠানের নাম কিংবা কতো টাকা ২য় লয়েস্ট তার কোনো তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন প্রতিষ্ঠানের সচিব গোলাম আক্তার ফারুক। প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষিত নোটিশ বোর্ডেও পাওয়া যায়নি দরপত্র আহবান কিংবা দরপত্র বিজয়ী সংক্রান্ত কোনো তথ্য।
২০১০ এবং ২০১১ সালের বাণিজ্য মেলার জন্য সকল পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে দরপত্র আহবান করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে, ২০১৮ সালের ১৪তম বাণিজ্য (অনুমোদনপ্রাপ্ত) বাণিজ্য মেলায় বিগত নিয়মটির উপেক্ষা করে মণিপুরি তাঁত শিল্প ও জামদানি বেনারসী কল্যাণ ফাউন্ডেশন নামক প্রতিষ্ঠানটিকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়োগ করা হয়। এমন তথ্য নিশ্চিত করে চেম্বার অব কমার্সের একটি সূত্র বিক্ষোভের সুরে জানান, বর্তমান সভাপতির সময়ে সিলেট চেম্বার এর আগেও অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চেম্বারের একজন পরিচালক বলেন, ‘এনআরবি গ্লোবাল কনভেনশন’ আয়োজনের নামেও সিলেট চেম্বারের আয়োজন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সেই প্রচেষ্টা সফলতার মুখ না দেখলেও ব্যক্তি বিশেষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে অনেক। দেশ-বিদেশের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সে সময় বিপুল পরিমান টাকা আদায় করা হলেও সে হিসেব আজো রয়ে গেছে অজানায়। তাছাড়া, এতোবড় আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামের শুরুতে বাজানো হয়নি কোনো জাতীয় সংগীত। এ নিয়ে অনুষ্ঠান স্থলে বিক্ষুব্ধ অনেকেই সিলেট চেম্বারের সভাপতির জামাতঘেঁষা অবস্থানের দিকে সে সময় আঙ্গুল তুলেন।
এবারও অদৃশ্য কারণে নিজ আসামীদের কাছে আবারো সিলেট ১৪ তম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলো চেম্বার কর্তৃপক্ষ। এর ফলে সিলেট চেম্বারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে বলে বিক্ষুব্ধ ঐ পরিচালক মনে করেন। সিলেট চেম্বারের ৫০ বছর অতিক্রান্ত। এই ৫০ বছরের শুরুতে ছিলেন তৎকালীন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা খন্দকার আব্দুল মালিক। বর্তমানেও শীর্ষ পদে আছেন আরো এক খন্দকার। তিনি সিপার এয়ারওয়েজের স্বত্ত্বাধিকারী খন্দকার শিপার আহমদ। খন্দকার থেকে খন্দকারে ৫০ পেরুলেও বিএনপি-জামাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ।
ফলে রাজনৈতিক কারণেই জাতিয়তাবাদী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানকে ইভেন্ট ম্যনেজমেন্ট নিয়োগ করলো সিলেট চেম্বার। তাছাড়া, মেলা আয়োজনের অনেক আগেই দরপত্র আহবান ছাড়াই চলতি বছরের শুরুর দিকে মেলার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকা গ্রহণ করে সিলেট চেম্বার। স্বচ্ছতার জন্য প্রতিষ্ঠানটি কোনো পত্রিকায় প্রকাশ করেনি বিজ্ঞপ্তি। প্রতিষ্ঠানটির অফিসে সংরক্ষিত নোটিশ বোর্ডেও দরপত্র সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। এর ফলে ২০১৮ সালের জন্য অনুষ্ঠিতব্য বাণিজ্য মেলায় বিগত রেওয়াজ ভঙ্গ করে চলতি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানটি।