হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার চার্জশিট আজ দেওয়া হতে পারে ॥ ২১ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ ॥ ৮ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট

22

কাজিরবাজার ডেস্ক :
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হতে পারে আজ সোমবার। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। চার্জশিটে ২১ জনের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ জন বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ায় তাদের ভূমিকা উল্লেখ করে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বাকি আটজনকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এর মধ্যে দু’জন এখনো পলাতক রয়েছে। মামলার তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। আশা করছি, আগামীকাল (আজ) আমরা আদালতে চার্জশিট জমা দেব।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গুলশান হামলার তদন্তে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মোট ২১ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা হলো তামিম চৌধুরী, সরোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান, তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদ, নূরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকোলেট, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম, রায়হান কবির ওরফে তারেক, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ, জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশ, সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদীসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জড়িতদের মধ্যে সরাসরি হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ জঙ্গি রোহান, নিবরাস, মোবাশ্বের, পায়েল ও উজ্জ্বল পরের দিন কমান্ডো অভিযানে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এছাড়া এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরীকে। ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশ সদর দফতর ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে দুই সহযোগীসহ মারা যায় তামিম। এছাড়া পরিকল্পনায় অন্যতম সহযোগী হিসেবে উল্লেখ রয়েছে সরোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমানের নাম। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় সারোয়ার জাহানের বাড়িতে র‌্যাব অভিযান চালালে পাঁচ তলা থেকে পালাতে গিয়ে নিচে পড়ে নিহত হয় সরোয়ার। গুলশান হামলায় হামলাকারীদের আশ্রয় ও অর্থদাতা হিসেবে নাম এসেছে তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদের নাম। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুর এলাকায় সিটিটিসির এক অভিযানে নিহত হয় তানভীর। নূরুল ইসলাম মারজানকে গুলশান হামলার পরিকল্পনাকারীর সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে চার্জশিটে। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এক সহযোগীসহ নিহত হয় মারজান। মারজানের মতো বাশারুজ্জামান চকোলেটও শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীর সহযোগী হিসেবে গুলশান হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সিটিটিসি’র এক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয় বাশার। গুলশান হামলায় অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহে মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজানের ভূমিকা ছিলো বলে তদন্তে উঠে এসেছে। বাশারুজ্জামানের সঙ্গে একই দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সিটিটিসি’র জঙ্গিবিরোধী অভিযানে মারা যায় মিজান। গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া হামলাকারীদের প্রশিক্ষক হিসেবে তদন্তে নাম এসেছে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া মেজর জাহিদুল ইসলামের। ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর মিরপুরের রূপনগরে সিটিটিসি’র জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয় জাহিদ। জাহিদের পাশাপাশি রায়হান করিব ওরফে তারেকও হামলাকারীদের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। তারেক ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে আট সহযোগীসহ নিহত হয়।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম রোববার রাতে বলেন, ‘আমরা সব ধরনের আইনগত কার্যক্রম শেষ করেছি। আশা করছি আগামীকাল (সোমবার) আদালতে চার্জশিট জমা দিতে পারবো।’
গ্রেফতার হওয়া ছয় জঙ্গি : গুলশান হামলা মামলায় জীবিত মোট আটজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী। হামলার পরিকল্পনাকারী, হামলাকারী ও সরবরাহকারী হিসেবে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ২০১৭ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের হাতে গ্রেফতার হওয়া রাজীব গান্ধী গুলশান হামলার আদ্যোপান্ত স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। গ্রেফতার হওয়া আরেক আসামি হলো আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশ। হামলার পরিকল্পনায় সহযোগী ও বাস্তবায়নকারী হিসেবে তদন্তে নাম এসেছে আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশের নাম। সে ছিল শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ। ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই নাটোর থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতে দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে সে। গুলশান হামলায় অস্ত্র, বোমা তৈরি ও সরবরাহকারী হিসেবে তদন্তে নাম এসেছে সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজের নাম। ২০১৭ সালের ৭ জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার পুষ্কনি এলাকা থেকে তিন সহযোগীসহ গ্রেফতার করা হয় তাকে। পরবর্তীতে কয়েক দফা রিমান্ড শেষে ২৩ জুলাই গুলশান হামলার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয়। সোহেল মাহফুজের মতো হাদীসুর রহমান সাগরের বিরুদ্ধেও গুলশান হামলায় বোমা তৈরি, অস্ত্র ও বোমা সরবরাহের অভিযোগ পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। চলতি বছরের (২০১৮) ২১ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে সাগরকে গ্রেফতারের পর দুই দফা রিমান্ড শেষে ৫ এপ্রিল গুলশান হামলায় সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে সাগর। গুলশান হামলা মামলায় রাকিবুল হাসান রিগ্যানের নাম এসেছে হামলাকারীদের প্রশিক্ষক হিসেবে। ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে পালিয়ে যাওয়ার সময় রিগ্যানকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। ওই বছরেরই ৩ অক্টোবার গুলশান হামলায় নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় রিগ্যান। আর মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানের বিরুদ্ধেও গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র, বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার সীমান্ত থেকে ঢাকায় আনার অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বনানী এলাকা থেকে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই বছরের ২৬ মার্চ গুলশান হামলার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সে।
পলাতক দুই জঙ্গি : গুলশান হামলায় অভিযুক্ত দুই জঙ্গিকে পলাতক দেখিয়ে চার্জশিট প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই দু’জন হলো মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালেদ। রিপনের বিরুদ্ধে গুলশান হামলায় পরিকল্পনা ও হামলাকারী সরবরাহকারী হিসেবে নাম এসেছে আর খালিদও গুলশান হামলায় পরিকল্পনায় সহযোগিতা, বাস্তবায়ন ও হামলাকারী সরবরাহে ভূমিকা রেখেছিল বলে জানতে পেরেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গুলশান হামলার পর থেকেই এই দু’জন পলাতক রয়েছে। ধারণা করা হয়, তারা ভারতে আত্মগোপনে রয়েছে।
অর্ধশতাধিক আলামত, সাক্ষী ১৮৭ জন : গুলশান হামলা মামলায় চার্জশিটের সঙ্গে অর্ধশতাধিক আলামতও আদালতে জমা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া এই মামলায় মোট ১৮৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। বিশেষ করে ঘটনার রাতে যারা জিম্মি হয়ে পরবর্তীতে বেঁচে ফিরে এসেছেন তাদের প্রায় সবাইকে সাক্ষী করা হয়েছে।
অব্যাহতি পাচ্ছেন হাসনাত করিম : আলোচিত এই মামলা থেকে অবশেষে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন ঘটনার রাতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে জঙ্গিদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকা হাসনাত রেজা করিম। এই মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ঘটনার ৩৪ দিনের মাথায় হাসনাত করিমকে প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে ওই বছরের ১৩ আগস্ট তাকে সরাসরি গুলশান মামলায় গ্রেফতার দেখায় তদন্ত কর্মকর্তা। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ঘটনার সঙ্গে হাসনাতের কোনও সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে।
‘জঙ্গি তকমা’ থেকে মুক্তি পাচ্ছেন সাইফুল ও শাওন : অবশেষে জঙ্গি তকমা থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন হামলার দিন নিহত হওয়া হোলি আর্টিজানের পিৎজা শেফ সাইফুল ইসলাম চৌকিদার এবং ঘটনার আটদিনের মাথায় নিহত হওয়া জাকির হোসেন শাওন। মামলার তদন্তে সাইফুল ও শাওনের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার কোনও প্রমাণ পাননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশি নাগরিক ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হয়। রাতভর জিম্মিদশার অবসান হয় পরদিন সকালে। পুলিশ ও র‌্যাবের সহায়তায় জিম্মিদের উদ্ধারে অভিযান চালায় সেনবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর একটি দল। এতে পাঁচ জঙ্গি ও হোলি আর্টিজানের এক পিৎজা শেফ নিহত হয়। এছাড়া চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরও এক সহকারী কুক। এ ঘটনায় গুলশান থানা পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করে।