রোহিঙ্গা সংকট ॥ অর্থ সংকুলানই বড় চ্যালেঞ্জ

25

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কবে ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার তা এখনো নিশ্চিত নয়। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। এর মধ্যে গত বছরের আগস্ট থেকে নতুন করে আসা ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। মিয়ানমারও মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু বাস্তবে ফিরিয়ে নেওয়া তো দূরের কথা; উল্টো দেশটির নানা কূটকৌশলের কারণে পরিস্থিতি দিন দিন আরো জটিল হচ্ছে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের দেওয়া ১০ হাজার রোহিঙ্গার দ্বিতীয় তালিকা নিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কারণ হিসেবে যদিও দেশটি বলছে, প্রথম তালিকা যাচাই-বাছাই শেষ করে দ্বিতীয় তালিকা নিতে চায় তারা। কিন্তু গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারকে দেওয়া ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার প্রথম তালিকা থেকে সাত দফা যাচাই-বাছাই করে মাত্র এক হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে দেশটি। এ রোহিঙ্গাদের নিজ বাসস্থানে না রেখে আলাদা ক্যাম্পে রাখার ও নাগরিকত্বের পরিবর্তে এনআইসি কার্ড দেবে দেশটি। ফলে সংগত কারণেই বাংলাদেশ এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
এমনকি সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের দ্বিতীয় বৈঠকও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো সুখবর দিতে পারেনি। বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন একটি জটিল প্রক্রিয়া। এখনো যাচাই-বাছাই চলছে। সমস্যা সমাধানে আরো সময় লাগবে।
এমন অবস্থার মধ্যে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে আবারও নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করেছে মিয়ানমার। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সরে যেতে নতুন করে মাইকিং শুরু করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এতে সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। তুমব্রু খালের পাহাড়ি ঢল থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা নোম্যান্সল্যান্ডে নতুন মাচান ঘর তৈরি শুরু করার পর সেনাবাহিনী এ মাইকিং করে। গত শনিবার সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়া ঘেঁষে কয়েক দফা মাইকিং করা হয়। মাইকিংয়ে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সেখান থেকে সরে গিয়ে অনত্র আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। এর আগে গত মার্চেও সীমান্তের নোম্যান্সল ল্যান্ডে অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে জোরপূর্বক প্রবেশ করাতে এ ধরনের উত্তেজনা তৈরি করেছিল মিয়ানমার।
এ নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের রোহিঙ্গা গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা। তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীর এই বিশাল চাপের কারণে দেশ দীর্ঘমেয়াদি বড় তিন ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন। এগুলো হলো সামস্টিক অর্থনীতি, সামাজিক ও পরিবেশ বিপর্যয় এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। তাদের পরামর্শ, প্রত্যাবাসন জরুরি। রোহিঙ্গারা যতদিন থাকবে ততই আর্থিকসহ নানা ক্ষতি বাড়বে। দেশকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে।
বিশেষ করে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক ক্ষতি ও পরিবেশ বিপর্যয়কে বড় করে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। এমনকি এসব রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণ ও খাদ্যসহ বিভিন্ন প্রয়োজন সংকুলানে ভবিষ্যৎ অর্থ সংকটের আশঙ্কাও করছেন তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে সূত্রগুলো বলছে, এ বছরের মার্চ থেকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ১০ মাসের জন্য ৯৫১ মিলিয়ন ডলার জরুরি অর্থ সহায়তার আন্তর্জাতিক আবেদন জানিয়েছে জাতিসংঘ। গত ১৬ মার্চ জেনেভায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে ওই সাহায্যের আবেদন জানানো হয়। গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম দফায় ৪৩৪ মিলিয়ন ডলারের আবেদন জানিয়েছিল জাতিসংঘ। ওই দফায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা পাওয়া গেছে। কিন্তু এবার বিশ্বজুড়ে নানা সংকটের কারণে এই দফায় রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যদাতাদের আগ্রহের ঘাটতি এবং অর্থপ্রাপ্তির গতি শ্লথ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এই রোহিঙ্গা সংকটের কারণে ব্যাপক অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডির) নির্বাহী পরিচালক এবং অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বলেন, দেশে যে রোহিঙ্গারা এসেছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়েছে। সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষতিও রয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতিটা খুব সহজেই হিসাব করতে পারি। চোখে পড়ে। অন্য ক্ষতিগুলো পরোক্ষ হিসেবেই আসে। সবগুলো যদি একসঙ্গে দেখি তা হলে কিন্তু বিরাট প্রভাব পড়ছে। প্রথমদিকে বিভিন্ন দাতাসংস্থা থেকে ও সরকারের উদ্যোগে আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী, সেখান থেকেও অর্থ এসেছে। এখন আবার নতুন করে জাতিসংঘ হিসেব দিয়েছে তাদের জন্য আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসের জন্য ৯১০ মিলিয়ন ডলার লাগবে। এই অর্থ সংকুলানই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, যখন যে দেশে শরণার্থীরা যায়, তখন প্রথমদিকে দাতাসংস্থা ও সরকারি যে সংস্থাগুলোর যে উদ্যোগ থাকে, সেটা কিন্তু আস্তে আস্তে স্তিমিত হতে থাকে। এক ধরনের স্থবিরতা আসে। তখন যে দেশে আসে সেই সরকারকেই দায়ভার নিতে হয়। সেই সরকারের খরচ করতে হয়। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই তাদের বাসস্থানের জন্য জায়গা দিয়েছে ও বাসস্থান তৈরি করে দেওয়ার জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। কিন্তু এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে এটাই সর্বশেষ খরচ। আগামী বাজেটেও তাদের জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ রাখা হবে। এটা তো স্বাভাবিকভাবেই চাপ।
এশীয় দুর্যোগ প্রস্তুতিমূলক কেন্দ্র (এডিপিসি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পাহাড়ি ঢল ও ভূমিধসের কারণে এক লাখ রোহিঙ্গা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ওই সমীক্ষার পর চরম ঝুঁকিতে থাকা অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গার আবাসনের জন্য পাহাড় কাটতে হয়েছে। এ ছাড়া কুতুপালং-বালুখালী শিবির এলাকা সম্প্রসারণের জন্য প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ করা জমির পরিমাণ দুই হাজার একর থেকে বাড়িয়ে চার হাজার একর করা হয়েছে। এ ছাড়া শুরুতে রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৪ হাজার ঘর তৈরির কথা থাকলেও পরে ঘরের সংখ্যা দুই লাখ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান জানান, উখিয়ায় আগে ২০টি শিবির ছিল। বর্তমানে বাড়িয়ে ৩০টি করা হয়েছে। কুতুপালং থেকে থাইংখালী পর্যন্ত বিস্তৃত বৃহদায়তন এলাকায় আছে এসব শিবির। বন বিভাগ এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য ৫ হাজার ৮০০ একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের এই চাপের কারণে সামাজিক ও পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ায় কক্সবাজারসহ ওই এলাকার পর্যটন, অর্থনীতি ও পরিবেশ ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে গাছপালা ও পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে, শরণার্থীরা খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ করায় ওই এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
এই পরিবেশবিদ আরো বলেন, বর্তমানে কক্সবাজারে চারজন বাংলাদেশি নাগরিকের বিপরীতে একজন রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। পাহাড় বা বনভূমির বড় একটা অংশ দখল করে আছে এসব রোহিঙ্গা। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি জীবিকার অন্বেষণে বনের কাঠ বিক্রি, মৎস্য আহরণ করছে এসব নাগরিক। যেখানে প্রাকৃতিক উপায়ে সাগর-নদীতে মৎস্য আহরণের পথ দিনদিন সংকুচিত হয়ে আসছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ জীবিকার টানে জেলের পেশা বেছে নিয়েছে; ঢুকে পড়েছে গণপরিবহন খাতেও। এতে সরাসরি অর্থনৈতিক খাতে ভাগ বসাচ্ছে তারা। আবার যে পরিবেশে তারা আছেন, সেখানে পর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও অবকাঠামো সুবিধা না থাকায় স্বাস্থ্যসেবায় ঝুঁকি বাড়ছে।
অন্যদিকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও শঙ্কিত বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুদের নিয়ে বেশি শঙ্কা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, ক্যাম্পে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ৬০ শিশু। নয় মাস আগে সংকট শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৬ হাজারের বেশি শিশুর জন্ম হয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র তিন হাজার শিশুর জন্মের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতা করার সুযোগ হয়েছে। নতুন মা হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেনÑ এমন প্রত্যেক নারী এবং তাদের নবজাতক শিশু যাতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা পায়, তা নিশ্চিত করা এখন জরুরি।
এদিকে রাখাইনে সামরিক অভিযানের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে ২ হাজার ২২৩ জনকে দ্রুত ফেরত পাঠানোর তাগিদ দিয়েছে মিয়ানমার। এদের মধ্যে বাংলাদেশের দেওয়া আট হাজার রোহিঙ্গার তালিকার মধ্যে মাত্র ১০০১ জন রয়েছেন। দেশটির সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুর্নবাসন মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ও যৌথ ওয়ার্কিং কমিশনের সদস্য উ কো কো নাইং রবিবার এই তথ্য জানিয়েছেন। সোমবার দেশটির সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার টাইমস এই খবর জানিয়েছে।