‘মহান মে দিবস’ প্রতিষ্ঠিত হোক শ্রমজীবী মানুষের অধিকার

203

প্রভাষক জ্যোতিষ মজুমদার

এ পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর, সৌন্দর্যময় সৃষ্টিশীল এবং নান্দনিক শিল্প, সবকিছুর মূলেই রয়েছে শ্রমজীবী মানুষের অবদান। পৃথিবীর মেহনতি শ্রমজীবী মানুষরাই আমাদের মহান সম্পদ এবং অহংকার। কিন্তু কৃষি সভ্যতা বিকাশের সময় থেকে দাসপ্রথা, বেগারখাটা এবং উৎপন্ন শষ্যভান্ডার কুক্ষিগত করার প্রবণতা সমাজে শ্রমজীবী মানুষদের বঞ্চিত করে চলছে প্রতিনিয়ত। স্ফীতকায় ধনতান্ত্রিক অচলায়তনে শ্রমিকদের চোখের জল আর বুকের রক্ত কোন মানবিক স্বীকৃতি পায়নি। ১৭৮০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দাবী দাওয়া, প্রতিবাদ এবং কাজ বন্ধ করে দেওয়া সহ বিভিন্ন আন্দোলনে ব্যাপৃত থাকে জুতা প্রস্তুতকারী শ্রমিক, ছুতার ও মুদ্রণ শিল্পে নিয়োজিত বিভিন্ন শ্রমিকরা। মূলতঃ এ সময়টা ছিল শ্রমিক ও মালিকে মতানৈক্যের ইতিহাস।
১৮০৬ সালে আমেরিকায় ফিলাডেলফিয়ার জুতা শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা কার্যঘন্টা কমানোর দাবীতে ধর্মঘট করেন এবং ১৮২৭ সালে কর্মঘন্টা কমানোর দাবীতে ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয় ফিলাডেলকিয়ার মেকানিক শিল্পের শ্রমিকের সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে।
আটঘন্টা কাজের সময়ের দাবীতে আন্দোলনের সর্বপ্রথম উদ্যোগ নিয়েছিল ইংল্যান্ডের ‘গ্রান্ড ন্যাশনাল কনসোলিডেটেড ট্রেডস ইউনিয়ন’। প্রথমে ২রা জুন ১৮৩৩ এবং তারপর সময় পিছিয়ে ১ সেপ্টেম্বর থেকে তারা ওই দাবীতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। ওই একই দাবীতে ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৭ থেকে ২৫ এপ্রিল ১৮৩৪ সালে লন্ডনে। আবার ১৮৩৬ সালেও লন্ডনে বিভিন্ন বৃত্তির সোসাইটিগুলোর জয়েন্ট কমিটি সপ্তাহে ৬০ ঘন্টার দাবিতে ৬ মাস সফলতার সাথে ধর্মঘট চালিয়েছিল।
১৮৪৫ সালে বিভিন্ন তুলা শিল্পে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ, স্যানিটেশন, ও কার্য্য সময় নিয়ে ম্যাচাচুয়েস্ট এ “দি ফিমেল লেবার রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন” গঠিত হয়। মে দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ১৮৫৭ খ্রি: ৮ই মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সুচ কারখানায় নারী শ্রমিকগণ তাদের প্রাপ্য মজুরীর বৈষম্য ও দৈনিক ১২ ঘন্টা কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠে।
১৮৬০ সালে নিউ ইংল্যান্ডে ২০ সহ¯্রাধিক জুতা তৈরীর শ্রমিক দাবী আদায়ের লক্ষ্যে সফল ধর্মঘট করেন। শ্রমিকদের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে বিশ্বের প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট হয়েছিল অবিভক্ত বঙ্গে ১৮৬২ সালের মে মাসে অর্থাৎ শিকাগো ঘটনায় আরো ২৪ বৎসর পূর্বে। ঐ ধর্মঘট ডেকেছিল রেলওয়ে শ্রমিকেরা। ১৮৬১-৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ক্রীতদাসদের মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত আমেরিকায় শ্রমিক আন্দোলনে জোয়ার বয়ে দিয়েছিল। ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে আন্দোলন এ সময় থেকেই সেখানে তীব্রতা লাভ করে। ১৮৬৬ সালে বাল্টিমোরে ৬০টি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিগণ কর্মঘন্টা ৮ ঘন্টা নির্ধারণের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন ১৮৮৪ সালে আমেরিকাার শিকাগো শহরে একদল শ্রমিক দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন এবং তাদের এ দাবী কার্যকর করার জন্য ১৮৮৬ সালের ১লা মে পর্যন্ত সময় সীমা রেখে দেন।
১৮৬৮ সালে আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন সভায় সরকারি শ্রমিকদের কার্যসময় ৮ ঘন্টা নির্ধারনের আইন পাস করা হয়, কিন্তু বেসরকারি শ্রমিকদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না।
এক সময় অমোঘ নিয়মে আবির্ভূত হলেন কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস। বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হল পৃথিবীব্যাপী শ্রমিকদের ঐক্য ঘোষণা। ১৮৪০ এর দশকে কাল মার্ক্স এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের দ্বারা পুঁজিবাদের উত্থান এবং নিয়মাবলী আবিষ্কার, এবং নিয়মাবলী অধিকার ১৮৬৪ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংঘঠনের প্রতিষ্ঠা এবং শ্রমিক আন্দোলনের বৈজ্ঞানিক প্রণালীসমূহের সূত্রায়ন, ১৮৭১ সালে ঐতিহাসিক প্যারি কমিউন এবং তার প্রথম আন্তর্জাতিক কেন্দ্রীয় দপ্তর আমেরিকাতে স্থানান্তরের ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে সমাজ তান্ত্রিক ভাবধারায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন প্রসারের প্রথম শর্তাবলী গড়ে উঠে।
১৮৮১ সালে জর্জিয়া আটলান্টায় লন্ড্রি শিল্পের কাজে নিয়োজিত তিন সহ¯্রাধিক কৃষাঙ্গ নারী শ্রমিক প্রভাববিস্তারকারী আন্দোলনের জন্ম দেয়। ১৮৮৪ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে একদল শ্রমিক দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন এবং তাদের এ দাবী কার্য্যকর করার জন্য ১৮৮৬ সালের ১লা মে পর্যন্ত সময় সীমা বেঁধে দেন।
মালিক আর মজুতদারদের অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে এবং নিজেদের ন্যূনতম প্রয়োজন সিদ্ধির দাবীতে আজ থেকে ১৩২ বছর পূর্বে ১৮৮৬ সালের মে মাসের প্রথম দিবসে শ্রমিকদের সমবেত পদাঘাতে প্রকম্পিত হয়েছিল শিকাগো শহর। শ্রমিকেরা কারখানায় না গিয়ে নেমে এলেন রাজপথে। আমেরিকার প্রায় ১৩ হাজার কল-কারখানায় তিন লক্ষাধিক শ্রমিক নানা রঙের ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে সমবেত হলেন। সফল সমাবেশ করে যার যার বাড়ী ফিরে গেলেন।
মে মাসের ৩ তারিখ সোমবার ধর্মঘট চলছে। ম্যাককর্মিক হার্ভেস্টার ওয়াকর্সের শ্রমিকরা ধর্মঘট ভাঙ্গতে আসা মালিক পক্ষ ও সরকারি পুলিশ বাহিনীর মোকাবিলা করতে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। স¤্রাজ্য লোভী ধন-তান্ত্রিক রাজশক্তির চন্ডাল নৃত্য সেদিন প্রকাশিত হয়েছিল জান্তব নগ্নতায়। পুলিশের গুলিতে ৬ জন শ্রমিক নিহত ও আহত হন অনেক। এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আগস্ট স্পাইসের সংগ্রামী আহ্বানে পরের দিন ৪ঠা মে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বোমা হামলায় আরো ৪ জন নিহত হন। পুলিশ শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ ও ধর্মঘটকারীরা মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। উক্ত সংঘর্ষে অনেক শ্রমিক মারা যায় এবং শিকাগো হে মার্কেট স্কোয়ারে চরম গণবিদ্রোহের ফলশ্র“তিতে কয়েকজন পুলিশ অফিসার সহ একজন বেসাময়িক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। পুলিশ হত্যা মামলায় ৮ জন শ্রমিক নেতাকে অভিযুক্ত করা হয়। বিচারের নামে হয় প্রহসন। ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লু্যুইস লিং একদিন আগেই জেলের ভিতরে আত্মহত্যা করেন। ফাঁসির মঞ্চে স্পাইস বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলেন আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে। ১৩ নভেম্বর তাদের শেষকৃত্যে আমেরিকার বৃহত্তম মিছিলে সমবেত হয়েছিল প্রায় ৫ (পাঁচ) লক্ষাধিক মানুষ।
আগস্ট স্পাইসদের যারা অন্যায় ভাবে ফাঁসি দিয়েছিল তারা আজ ঐতিহাসের আদালতে অভিযুক্ত হয়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে আঁস্তাকুড়ে আর আগস্ট স্পাইসরা অভিষিক্ত হন বীরের আসনে। ১৮৯৩ সালে ইলিয়নের গভর্ণর অভিযুক্ত ৮ জনকেই নিরাপরাধ ঘোষণা করেন এবং রায়ের হুকুম দাতা পুলিশ কমান্ডারকে অভিযুক্ত করা হয়।
মার্ক্সবাদের মহান পথ প্রদর্শক কার্ল মার্ক্সের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সহকর্মী ফেডারিক এঙ্গেলসের নেতৃত্বে ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পুর্তিতে ১৪ জুলাই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ২০ টি দেশের কমিউনিস্ট প্রতিনিধিরা এ কংগ্রেসে যোগদান করেন। সেই কংগ্রেসে ‘পহেলা মে’ কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস বা ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করেন। ঘোষণাতে বলা হয় ১৮৯০ সালের ‘পহেলা মে’ থেকে প্রতিবছর ‘পহেলা মে’ কে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। ঐতিহাসিক এ মে দিবসে বিশ্বের শ্রমজীবী জনতার প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি।