তিন মাসে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শাবি ছাত্রসহ ৬ জন খুন

94

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
চলতি বছরে ৩ মাসে নগরী ও দক্ষিণ সুরমাতে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবকলীগ ও শাবি ছাত্রসহ ৬ জন খুন হয়েছেন। বছরের শুরুতে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে খুন হন ১ নেতা। এর মধ্যে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছেন ২ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। এছাড়া তুচ্ছ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবকলীগের ২ নেতা এবং দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হন শাবির এক ছাত্র। এসব হত্যাকান্ডের ঘটনার সাথে জড়িত কিছু অপরাধীদের গ্রেফতার করতে পেরেছে সিলেটের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহির সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট থানায় এসব খুনের ঘটনায় মামলাও দায়ের করা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ মার্চ রাত ১ টার দিকে নগরীর দক্ষিণ কীন বিজ সংলগ্ন এলাকায় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে মাহিদ আল সালাম (২৮) নামের শাবির এক ছাত্র খুন হন। মাহিদ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি শাবি থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে কিছুদিন বাংলালিংক কোম্পানিতে চাকুরী করেছেন। জানা যায়, চাকুরি সংক্রান্ত ব্যক্তিগত কাজে মাহিদ রবিবার রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাসা থেকে বের হন। ১টার দিকে কদমতলী এলাকায় একদল দুর্বৃত্ত তার হাঁটুর পেছনে ছুরিকাঘাত করে। সেখানে অচেতন অবস্থায় এক রিকশাচালক তাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হয়। রিক্সাচালক মাহিদকে নিয়ে কীন ব্রিজ এলাকায় এলে সেখান থেকে পুলিশ রাত আড়াইটার দিকে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।
মাহিদের চাচা সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এটিএমএ হাসান জেবুল জানান- চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য মাহিদ রবিবার রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। হঠাৎ রাতে একজন আমাকে ফোন করে বলেন পুলিশ মাহিদের পরিবারকে খুঁজছে। সাথে সাথে আমি পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে ঘটনা জানতে পারি। পরে হাসপাতালে এসে দেখি সে আর নেই। মাহিদের ব্যাগ থেকে তার শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন কাগজপত্র পাওয়া গেছে। মাহিদের খালু সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এডভোকেট শামসুল ইসলাম বলেন- রাতে মাহিদের এ খবর শুনে সাথে সাথে ছুটে আসি সিলেট ওসমানী মেডিকেলে। সেখানে এসে তাকে ওপারেশনে নিয়ে যাওয়ার আগেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে মাহিদ।
নিহত মাহিদ নগরীর পাঠানটুলা আবাসিক এলাকার মৃত এডভোকেট মো. আব্দুস সালামের পুত্র। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মাহিদ আল সালাম সবার ছোট। তার এক বোন আফসানা সালাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক, আরেক বোন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসক এবং ভাই লন্ডন প্রবাসী।
গত ১ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে ৪টায় নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মিছিলে ছাত্রদল কর্মীর ছুরিকাঘাতে আবুল হাসনাত শিমু (২৫) নামে এক ছাত্রদল নেতা খুন হয়েছেন। শিমু নগরীর আরামবাগ এলাকার আব্দুল আজিজের পুত্র। তিনি ১৯ নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ছাত্রদলের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মিছিলে অংশ নেয় শিমু। এ সময় ছাত্রদলের দু’গ্র“পের মধ্যে মারামারি শুরু হলে তার বুকে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে দ্রুত তাকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ৩ জানুয়ারি সিলেটে ছাত্রদল নেতা আবুল হাসনাত শিমু (২৫) হত্যাকান্ডের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহতের মামা তারেক আহমদ লস্কর বাদী হয়ে সিলেট কোতোয়ালী থানায় এ মামলা দায়ের করেন। মহানগর ছাত্রদল নেতা নাবিল রাজা চৌধুরীকে প্রধান আসামি ও মদন মোহন কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি কাজি মেরাজকে দ্বিতীয় আসামি করে দায়ের করা মামলায় অপর আসামিরা হলেন- ছাত্রদল কর্মী মিজানুর রহমান, জাহেদ আহমদ, ইমাদ উদ্দিন, জাকি, নাহিয়ান রিপন, তুষারসহ অজ্ঞাত আরও ৬ থেকে ৭ জন।
গত ৭ জানুয়ারি অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে নগরীর টিলাগড়ে তানিম খান (২৫) নামে এক ছাত্রলীগকর্মী খুন হয়েছেন। ওইদিন রাত পৌনে ৯টার দিকে টিলাগড় পয়েন্ট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ছাত্রলীগকর্মী তানিম সিলেট সরকারি কলেজের ডিগ্রি পাস কোর্সের ছাত্র ও টিলাগড় এলাকার ছাত্রলীগকর্মী। তার সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায় ভুরুঙ্গা এলাকার ইসরাইল খানের পুত্র। ৪ জানুয়ারি টিলাগড় এমসি কলেজে আওয়ামী লীগ নেতা আজাদ-রঞ্জিত গ্র“পের দ্বন্দ্বের জের ধরে খুনের এ ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। ১০ জানুয়ারি তানিম খান খুনের ঘটনায় ৩৪ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাটি দায়ের করেন নিহত তানিমের বন্ধু এমসি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন রাহী। মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা ও সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ গ্র“পের ছাত্রলীগ কর্মী সাদিকুর রহমান আজলা ও ডায়মন্ড, রুহেলসহ ২৯ জনের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত ৪/৫ জনকে আসামি করা হয়।
গত ২৪ ফেব্র“য়ারী বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাত করে শিমুল দেব (৩২) নামে এক যুবককে খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। গভীর রাতে নগরীর সুবিদবাজারের নুরানী আবাসিক এলাকার দস্তিদারদীঘি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে রাত ২টার দিকে নিহতের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত শিমুল দেব সুবিদবাজার মিয়া ফাজিল চিশত এলাকার সমরেশ দেবের পুত্র। নিহতের পরিবারের বরাত দিয়ে স্থানীয়রা জানান, পূর্ব বিরোধের জের ধরে রাত ১২টার দিকে কয়েকজন যুবক শিমুলকে বাসা থেকে ডেকে নেয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে নৈশপ্রহরী দস্তিদারদীঘির ঘাটে মরদেহ দেখে মহানগরীর এয়ারপোর্ট থানায় খবর দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে সিলেট বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশররফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, নৈশ প্রহরীর খবরে রাত ২টার দিকে মরদেহ উদ্ধার করে হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ২৪ ফেব্র“য়ারী শিমুল দেব খুনের ঘটনায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিকেলে এসএমপির কোতোয়ালি থানায় এ মামলা (৩১ (০২)’১৮) দায়ের করেন নিহতের ভাই নন্দন দেব।
গত ৬ মার্চ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। এতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও যুবলীগের ২ নেতা খুন হন। এ ঘটনায় আহত হন অন্তত ৩০ জন। আহতদের মধ্যে ১৭ জন গুলিবিদ্ধ। ওইদন সকালে দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দী ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি গৌছ মিয়া ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার তেলিরখাল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আ’লীগ নেতা আলফু মিয়ার সমর্থকদের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন-বরইকান্দি ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের একটি ওয়ার্ডের সহ-সভাপতি মাসুক মিয়া ও যুবলীগ নেতা বাবুল মিয়া। স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সিএনজি চালিত অটোরিকশার বাড়তি ভাড়া আদায়কে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এসময় আলফু মিয়া পক্ষের ৮ থেকে ১০ জন লোক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে গুলি করতে থাকেন। এতে ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মাসুক ও বাবুল মিয়া। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন আ’লীগ নেতা গৌছসহ ১৭ জন। ৮ মার্চ শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা খুনের ঘটনায় ৯শ’ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। সংঘর্ষে নিহত স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বাবুল মিয়ার বড় ভাই সেবুল মিয়া বাদী হয়ে ১০৯ জনের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৭/৮শ’ জনের বিরুদ্ধে এ মামলা করেন।