সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলামে নির্দেশনা

47

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
ইসলামী আইনের দ্বিতীয় উৎস আল-হাদীসের সন্ত্রাস শব্দটি সরাসরি ব্যবহৃত না হলেও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিভিন্ন দিক বুঝাতে বেশ কিছু পরিভাষার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। সেসব পরিভাষার অন্যতম হলো, আল-কতলু বা হত্যা, আয-যুলম বা অত্যাচার, আত-তারভী, বা ভয় প্রদর্শন, হামলুছ ছিলাহ বা অস্ত্র বহন করা, আল-ইশারাতু বিছ-ছিলাহ বা অস্ত্র দ্বারা ইঙ্গিত করা ইত্যাদি। তবে এসব পরিভাষা ছাড়াও বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে সন্ত্রাসীদের কর্মকান্ডকে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ বুঝাতে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার কয়েকটি নিম্নে উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হলো। একে অপরের প্রতি অত্যাচার করা নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন: “হে আমার বান্দাগণ! আমি আমার জন্য অত্যাচার হারাম করেছি এবং তা তোমাদের জন্যও হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর অত্যাচারে লিপ্ত হয়ো না।” স্বাভাবিকভাবে একজনের রক্ত, সম্পদ, সম্মান হানী করা অপরজনের জন্য হারাম। রাসূল (সা.) বলেন: তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্মান পরস্পরের জন্য ঐরূপ হারাম যে রূপ হারাম তোমাদের এই শহর, তোমাদের এই মাস এবং তোমাদের এই দিন কোন মুসলিমকে আতঙ্কিত করা অবৈধ। রাসূল (সা.) বলেন: “কোন মুসলিমের জন্য অপর মুসলিম ভাইকে আতঙ্কিত বা সন্ত্রস্ত করা বৈধ নয়।” কোন মুসলিমের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণকারী ব্যক্তি মুসলিম উম্মাহর সদস্য নয়। এ মর্মে রাসূল (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি তোমাদের (মুসলিমদের) বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” কোন মুসলিমে অস্ত্র দ্বারা হুমকি দেয়া নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.) বলেন: “তোমাদের মাঝে কেউ যেন তার মুসলিম ভাইয়ের প্রতি অস্ত্র দ্বারা হুমকি না দেয়। কেননা হতে পারে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও শয়তান তার হস্তদ্বয় আঘাত হানার ফলে হতাহতের ঘটনা ঘটবে; অতঃপর সে এ অপরাধের কারণে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে”। রাসূল (সা.) বলেন: “কোন ব্যক্তি যদি লোহা দ্বারা তার ভাইকে হুমকি দেয় তবে তা থেকে বিরত না হওয়া পর্যন্ত ফিরিশতাগণ তার প্রতি অভিশাপ করতে থাকেন যদিও হুমকি প্রদানকৃত ব্যক্তি তার সহোদর ভাই হয়।” আত্মঘাতি হামলার মাধ্যমে আত্মহত্যাও হারাম। রাসূল (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি পৃথিবীতে নিজেকে কোন বস্তু দ্বারা হত্যা করবে কিয়ামতের দিন তাকে সে বস্তু দ্বারা শাস্তি দেয়া হবে।” রাসূল (সা.) আরো বলেন: “যে ব্যক্তি নিজেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করবে তাকে জাহান্নামে অনুরূপভাবে শাস্তি দেয়া হবে। যে ব্যক্তি নিজেকে আঘাত করে আত্মহত্যা করবে তাকেও জাহান্নামে অনুরূপভাবে আঘাত করা হবে।”
শুধু মুসলিম ব্যক্তি নয়, কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমে হত্যা করাও নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি মুসলিম জনপদে বসবাসকারী চুক্তিবদ্ধ কোন অমুসলিমকে হত্যা করবে সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ চল্লিশ বছরের পথের দূরত্ব হতেও তার সুগন্ধ পাওয়া যাবে।” সন্ত্রাসীর অন্তরে দয়ামায়া থাকে না, তাই সে হতভাগা। রাসূল (সা.) বলেন: “একমাত্র দুর্ভাগা ব্যক্তি হতেই দয়া ছিনিয়ে নেয়া হয়”। ইচ্ছাকৃত কোন মু‘মিনকে হত্যা করা বড় গুনাহসমূহের অন্যতম যার গুনাহ আল্লাহ মা‘ফ করবেন না। রাসূল (সা.) বলেন: “আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপনকারী ও ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মু‘মিন ব্যক্তিকে হত্যার গুনাহ ব্যতীত অন্য যে কোন গুনাহকে আল্লাহ হয়তো ক্ষমা করে দিবেন।” অন্যায়ভাবে মু‘মিনকে হত্যাকারীর কোন ইবাদত কবুল করা হবে না। রাসূল (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোন মু‘মিন ব্যক্তিকে হত্যা করবে আল্লাহ তার কোন নফল ও ফরয ইবাদত কবুল করবেন না।” নিষিদ্ধ পন্থায় অপরের রক্তপাত ঘটানো মু‘মিনকে উচ্চ মর্যাদা থেকে স্খলিত করে। রাসূল (সা.) বলেন: “মু‘মিন ব্যক্তি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন জীবন-যাপন করতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত হারাম পন্থায় অন্যের রক্তপাত না ঘটাবে।” কোন মুসলিমকে হত্যা করা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার থেকেও গুরুতর। রাসূল (সা.) বলেন: “আল্লাহর নিকট সারা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার চেয়েও গুরুতর হচ্ছে কোন মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করা।” নিরাপত্তা প্রদানকৃত যে কোন ধর্মাবলম্বীকে হত্যাকারীর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। রাসূল (সা.) বলেছেন- “যে ব্যক্তি নিরাপত্তা প্রদানকৃত ব্যক্তিকে হত্যা করে আমার সাথে ঐ হত্যাকারীর কোন সম্পর্ক থাকবে না, যদিও নিহত ব্যক্তি কাফির হয়।”
আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা হলো ইসলাম। আল্লাহ বলেন: “নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন। অন্য স্থানে আল্লাহ বলেন, “কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” ইসলাম শব্দের ব্যুপত্তিগত অর্থই শান্তি। এ জীবনব্যবস্থার এরূপ নামকরণই প্রমাণ করে যে, মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার চিন্তা ইসলামের সামগ্রিক প্রকৃতি ও মৌল দৃষ্টিকোণ হতে উৎসারিত। তাই ইসলামের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান থেকে শান্তির ফল্গুধারা নিঃসৃত হয়। শান্তিময় পরিবেশের স্থায়িত্ব বজায় রাখার শান্তি বিঘিœত করে এমন সকল কর্মকান্ড প্রতিরোধ অপরিহার্য। তাই যৌক্তিকভাবেই ইসলাম শান্তি প্রতিষ্ঠা ও এর স্থায়িত্ব বজায় রাখার স্বার্থে সকল ধরণের সন্ত্রাসকে প্রতিরোধে ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্র্মূল করার নির্দেশনা দান করে। ইসলাম বলতে প্রথমত ও প্রধানত কুরআন ও রাসূল (সা.) এর সুন্নাহ বা হাদীসকেই বুঝায়। রাসূল (সা.) বলেছেন: “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম, এই দু‘টি জিনিসকে যতক্ষণ আঁকড়ে ধরে রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না, সে দু‘টি জিনিস হলো আল্লাহর কিতাব তথা কুরআনও তঁর রাসূল (সা.) এর সুন্নাহ তথা হাদীস।” তাই সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা বলতে সন্ত্রাস প্রতিরোধে কুরআন ও রাসূল (সা.) এর সুন্নাহতে বর্ণিত নির্দেশনাসমূহ বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য যে, সন্ত্রাস প্রতিরোধক আয়াত, হাদীস ও রাসূল (সা.) এর আদর্শ এত বেশি যে, তার সবগুলো এই স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা অসম্ভব। তাই এ ব্যাপারে ঐ তিন উৎসের মৌলিক নির্দেশনাসমূহ নিম্নে পেশ করার প্রয়াস পাচ্ছি। (অসমাপ্ত)