খালেদা জিয়ার মামলার নথি হাইকোর্টে পৌঁছেছে, আজ জামিন পেতে পারেন

41

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অবশেষে হাইকোর্টে পৌঁছেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলার নথি। বহুল আলোচিত জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ২০ দিন পর মামলার নথি হাইকোর্টে পৌঁছল। এই নথির ওপরই নির্ভর করছে খালেদা জিয়ার জামিন। রবিবার বেলা ১২টা ৫৪ মিনিটে কোতোয়ালি থানার এএসআই মঞ্জু মিয়া বড় একটি ট্রাংকে করে মামলার নথি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছান। এর পর হাইকোর্টের আদান-প্রদান শাখায় নথি গ্রহণ করেন সেকশন কর্মকর্তা কেএম ফারুখ হোসেন। সেখান থেকে মামলার নথি ফৌজদারি আপিল বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের এই মামলায় ৫ বছরের সাজা নিয়ে কারাগারে থাকা খালেদা জিয়া জামিন পাবেন কি না, এই নথি দেখে সোমবার তা জানাবে উচ্চ আদালত। এর আগে রবিবার সকালেই খালেদা জিয়ার জামিন প্রশ্নে আদেশ দেওয়ার কথা ছিল বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চের। কিন্তু নথি পৌঁছাতে বিলম্বের কারণে আদেশ পিছিয়ে সোমবার নিয়ে যাওয়া হয়।
ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান গত ৮ ফেব্র“য়ারি এ মামলার রায়ে ৫ বছরের সাজা দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠান। ওই রায়ের বিরুদ্ধে খালেদার আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে গত ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট নিম্ন আদালত থেকে মামলার নথি তলব করে। আর ২৫ ফেব্র“য়ারি খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট জানায়, নিম্ন আদালত থেকে নথি পাওয়ার পর জামিন বিষয়ে আদেশ দেওয়া হবে।
জানা যায়, খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের আবেদনে বিষয়টি রবিবার আদেশের জন্য কার্যতালিকায় রাখা হয়। কিন্তু নথি তখনও না আসায় বিএনপিনেত্রীর আইনজীবী জয়নুল আবেদীন সকালে আদালতকে বলেন, এ জামিনের জন্য রেকর্ডের প্রয়োজন নেই। এই কোর্টের ট্র্যাডিশন আছে রেকর্ড ছাড়াই জামিন দেওয়ার। এই কোর্টের সেই পাওয়ারও আছে। এ সময় বিচারক বলেন, নজির আছে ঠিক। কিন্তু আমরা তো রেকর্ড তলব করেছি। আমরা ওই অর্ডার দিয়েছিলাম ২২ ফেব্রুয়ারি, মাঝে সাপ্তাহিক ছুটি ছিল। সে অনুযায়ী আজ ১৫ দিন শেষ হবে। দেখা যাক অর্ডার প্রতিপালন করে কিনা। আমরা আগামীকাল অর্ডারের জন্য রাখলাম।
রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ আহম্মেদ এবং দুদকের পক্ষে খুরশীদ আলম খান এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলন। আর খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের মধ্যে জয়নুল আবেদীন ছাড়াও এ জে মোহাম্মদ আলী, খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, নিতাই রায় চৌধুরী, কায়সার কামাল, সগীর হোসেন লিয়ন ও এহসানুর রহমান আদালতে ছিলেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে খন্দকার মোশারফ হোসেন, মঈন খান, মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, জয়নুল আবদিন ফারুক ও আবদুল আউয়াল মিন্টু উপস্থিত ছিলেন আদালতে।
এদিকেআজ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে খালেদার জিয়ার জামিনের ব্যাপারে আদেশ দিতে পারেন আদালত। এই আদেশের ওপরই নির্ভর করছে বিএনপির ভবিষ্যৎ নির্বাচনী রাজনীতির গতি-প্রকৃতি। আদেশ পক্ষে-বিপক্ষে যাওয়ার ওপর ভিত্তি করেই রাজনীতির নতুন কৌশল নেবে দলটি।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, বিএনপি মনে করে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ না থাকলে আজ জামিন পাবেন খালেদা জিয়া। তবে এ নিয়ে বিএনপি নেতারা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। কোনো কারণে হাইকোর্টের জামিন নাকচ হলে সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ আদালতে যাবেন খালেদার আইনজীবীরা। এছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানায় থাকা অন্য মামলাগুলোতে সরকার যদি খালেদাকে নতুন করে আটক রাখে, সেক্ষেত্রে বিএনপি রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাববে দলটি। তবে দলটির নেতারা বরাবরই বলে আসছেন, খালেদার মুক্তিতে তারা আইনি ও রাজপথ দুই দিকেই প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যাবেন। এটি নিয়ে নতুন কোনো চিন্তার অবকাশ নেই বলে জানান তারা।
তবে গত একমাস ধরে কারাগারে থাকা খালেদার জামিন ও মুক্তি পাওয়ার বিষয়ে দলের সব পর্যায়ে ইতিবাচক ধারণা আছে। নেতারা মনে করেন, আজ অবশ্যই জামিন পাবেন খালেদা জিয়া। হাইকোর্ট জামিন শুনানি শেষ করার পর আদেশ না দেওয়াকে নজিরবিহীন বললেও এ নিয়ে দলটির আইনজীবী ও নেতারা তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। এই সিদ্ধান্ত জানার জন্য তাদের টানা তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়েছে।
এ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলাটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিন্ধান্ত। সরকার এক তরফাভাবে আবারও পাতানো নির্বাচনের পথে হাঁটছে। আমাদের চেয়ারপারসনকে কারাগারে রেখে সেই পথে একধাপ এগোনোর চেষ্টা হয়তো তারা করেছে। কিন্তু ন্যায় বিচার হলে তিনি খালাস পাবেন। একজন সিনিয়র নাগরিক হিসেবে জামিন পাওয়া তার অধিকার।’ তিনি আরো বলেন, ‘সম্প্রতি আমাদের সাবেক একজন সাবেক এমপি নি¤œ আদালতে ১০ বছর সাজা পাওয়ার পরও এই কোর্টেই জামিন লাভ করেন। বিএনপি মনে করে সম্পূর্ণ সরকারের ইচ্ছায় খালেদা জিয়ার জামিন ব্যাপারটি বিলম্ব হচ্ছে।’
নতুন কোনো মামলায় আটক বা জামিন না হলে কী করবে বিএনপি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি খালেদা জিয়ার মামলাটি যেহেতু একটি রাজনৈতিক মামলা তাই রাজপথ এবং আইনি মোকাবিলাকেই আমরা প্রাধান্য দেব। খালেদাকে জেলে আটক রেখে একক নির্বাচন করার সরকারি খায়েশ এইবার পূরণ হবে না।’
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা জানান, ‘এ মামলায় জামিন হবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর। দুদকের মামলায় ৫-১০ বছরের সাজা হলেও আসামির জামিনের নজির আছে। অন্য কোনো মামলায় যদি নতুন করে গ্রেফতার দেখানো না হয় তবে জামিন পেলে খালেদা জিয়ার কারামুক্তিতে বাধা নেই। এর আগে দায়ের করা চারটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে।’ দুদকের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তারা খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা করবেন। এরপরও জামিন হলে কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। সেক্ষেত্রে তারা আদেশের বিরোধিতা করে চেম্বার জজ আদালতের দ্বারস্থও হতে পারেন। খালেদা জিয়ার নামে অন্য কোনো মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট আছে কিনা এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। এ বিষয়ে উনারা ভালো বলতে পারবেন। আমি শুধু বলব—আইন আইনের গতিতে চলবে।
গতকাল সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে আদালতের এখতিয়ার। আদালতে তিনি জামিন পেতেও পারেন, নাও পেতে পারেন। উচ্চ আদালত তার সাজা বহাল রাখতেও পারে, তাকে ছেড়েও দিতে পারে। পরিষ্কার বক্তব্য সরকার কোনোভাবেই এখানে হস্তক্ষেপ করবে না। এখন তারা যদি মনে করে খালেদা জিয়াকে আন্দোলন করে বের করবে সেই আশায় এখন গুড়েবালি।
তবে বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারটিকে নির্বাচনী ইস্যু বানাতে চাচ্ছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তিই নির্বাচনী মাঠ সমতল হওয়ার প্রথম শর্ত। তারপর নির্বাচন, সহায়ক সরকার, সংলাপসহ অন্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল শনিবার দুপুরে বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, সর্বপ্রথম দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি। এরপর সহায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার মধ্যেই কেবল নির্বাচনী মাঠ সমতল হওয়ার প্রথম শর্ত পূরণ হবে।
অপরদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও খালেদার মুক্তির বিষয়টিকে নির্বাচনী ইস্যু বানাতে চাচ্ছেন। গত পরশু তিনি গণমাধ্যমে বলেন, সরকার যদি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচন করার পরিকল্পনা করে থাকে, তাহলে তা ‘অলীক স্বপ্ন’ হবে। শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি আবারও বলেছেন, ‘ভিত্তিহীন’ মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হয়েছে কেবল তাকে কারাগারে রাখার জন্য, যাতে তাকে এবং বিএনপিকে নির্বাচন থেকে ‘দূরে রাখা’ যায়। জামিন বিষয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের মামলায় আপিল হলে জামিন পাওয়া তার অধিকার। সেখানেও তারা (সরকার) হস্তক্ষেপ করেছে, আজকে তিনি সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত। আওয়ামী লীগ যেকোনো প্রকারে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সারা দেশে ‘ভয়াবহ দুঃশাসন’ চালাচ্ছে।
ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান গত ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায়ে পাঁচ বছরের সাজা দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠান।