সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলামে নির্দেশনা

154

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে প্রতিযোগিতা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে সন্ত্রাস। সন্ত্রাস একদিকে যেমন বিশ্ব শান্তিকে হুমকির মুখে দাঁড় করে দিয়েছে অন্যদিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে সভ্যতার সৌধকে। বর্তমান বিশ্বে ইসলামকে সন্ত্রাসের সাথে একাকার করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ মানবসভ্যতার শুরুতেই সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত নিয়ে ইসলাম পৃথিবীতে এসেছে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা সন্ত্রাসের সাথে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে, এর দ্বারা ইসলামপ্রিয় জনগোষ্ঠিকে আতঙ্কিত করে তোলা হচ্ছে এবং বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি করা হচ্ছে। অত্র প্রবন্ধে সন্ত্রাস এর সংজ্ঞা, কুরআন ও হাদীসে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ, সন্ত্রাস প্রতিরোধে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা ও মহানবী (সা.) এর কার্যক্রম বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
সন্ত্রাস একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নির্ধারণ বর্তমান মতবিরোধপূর্ণ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একপ্রকার অসম্ভবই বটে। কারণ ব্যক্তি বা গোষ্ঠির দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা যে কোন বিষয় বা মতবাদের সংজ্ঞার ভিন্নতা নির্দেশ করে। তাই তো দেখা যায়, এক গোষ্ঠির দৃষ্টিতে যে কর্মকান্ড সন্ত্রাসের মতো নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত কর্ম, অপর গোষ্ঠির দৃষ্টিতে সে কর্মকান্ডই স্বাধীনতা কিংবা স্বাধিকার আদায় সংগ্রামের মতো মহৎ ও প্রশংসনীয় কর্ম। সন্ত্রাসের সংজ্ঞায়নে বিতর্ক থাকলেও বক্ষ্যমান আলোচনার উদ্দেশ্য অর্জনের প্রয়োজনে সন্ত্রাসের একটি সু-নির্দিষ্ট পরিচয় নির্ধারণ আবশ্যক।
সন্ত্রাস শব্দটি বাংলা ‘ত্রাস’ শব্দ উদ্ভূত। যার অর্থ ভয়, ভীতি, শঙ্কা। আর সন্ত্রাস অর্থ হলো, মহাশঙ্কা, অতিশয় ভয়, কোনো উদ্দেশ্যে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা, অতিশয় শঙ্কা বা ভীতি, অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ, ভীতিজনক অবস্থা, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক পরিবেশ। সন্ত্রাস এর সমার্থক শব্দ হিসাবে সন্ত্রাসবাদ, আতঙ্কবাদ, বিভীষিকাপন্থা, সহিংস আন্দোলন, উগ্রপন্থা, উগ্রবাদ, চরমপন্থা ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে সন্ত্রাস কোন বিচ্ছিন্ন কর্মকান্ড নয়। বর্তমানে এটি একটি মতবাদে পরিণত হয়েছে। তাই সন্ত্রাস ভিত্তিক বা কেন্দ্রিক মতবাদ ও কর্মকান্ডকে বুঝাতে সন্ত্রাসবাদ শব্দটি বহুল প্রচলিত। অভিধানে “সন্ত্রাসবাদ” অর্থ লেখা হয়েছে যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য হত্যা অত্যাচার ইত্যাদি কার্য অনুষ্ঠাননীতি, রাজনীতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য পীড়ন, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক কর্ম অবলম্বন করা উচিত- এই মত। ইংরেজীতে সন্ত্রাস অর্থ বুঝাতে ঞবৎৎড়ৎ: মৎবধঃ ভবধ/ধষধৎস বীঃৎবসব ভবধৎ, ঃযব ঁংব ড়ভ ড়ৎমধহরুবফ রহঃরসরফধঃরড়হ ঃবৎৎড়ৎংস [নধংবফ ড়হ ষধঃরহ ঃবৎৎবৎব ড়ঃড় ভৎরমযঃবহ”, শব্দসমূহ ব্যবহৃত হয়।
আধুনিক আরবি ভাষায় সন্ত্রাস শব্দের প্রতিশব্দ হলো (ইরহাব)। এ শব্দটি এসেছে (রাহবুন) থেকে যার অর্থ (খাফ) ভীত হলো, ভয় পেলো ইত্যাদি। আর (ইরহাব) অর্থ হলো (তাখভীফ) ও (তাফযী), তথা ভীতিপ্রদর্শন, শঙ্কিতকরণ, আতঙ্কিতকরণ। সন্ত্রাস এর শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থের ব্যাপারে মতানৈক্য তেমন না থাকলেও এর পারিভাষিক সংজ্ঞা নির্ধারণে যথেষ্ট মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। আর এই মতানৈক্যের কারণেই আজ পর্যন্ত সন্ত্রাস এর সর্বসম্মত কোন পারিভাষিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক এষড়নধষ ঃবৎৎড়ৎরংস এর উপর প্রকাশিত ধহহঁধষ ৎবারবি ২০০০ এ বলা হয়েছে যে, ঘড় ড়হব ফবভরহধঃরড়হ ড়ভ ঃবৎৎড়ৎরংস যধং মধরহবফ ঁহরাবৎংধষ ধপপবঢ়ঃধহপব অর্থাৎ সন্ত্রাসের কোন সংজ্ঞা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। প্রত্যেক মতবাদীরাই নিজ নিজ বিশ্বাস দৃষ্টিভঙ্গির ভিএি সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, দেশীয়, আঞ্চলিসক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ সন্ত্রাসের সংজ্ঞায়নে চেষ্টা অব্যহত রেখেছে। বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাস কেন্দ্রিক আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে দুইটি প্রধান দর্শন। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের সমন্বয়ে গঠিত পাশ্চাত্য দর্শন। অপরটি ইসলামী দর্শন। তাই সন্ত্রাস এর সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ উভয় দর্শন থেকে প্রদত্ত সংজ্ঞাসমূহ উল্লেখ করা হলো।
যায়েদ ইবনু মুহাম্মদ ইবনে হাদী আল-মাদখালী বলেন, ‘ইরহাব (সন্ত্রাস) এমন একটি শব্দ বিভিন্ন আঙ্গিকে যার অনেক অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে- নিরপরাধ অন্যায়ভাবে নির্দোষ মানুষকে ভয় দেকানো ও শঙ্কিত করা। কখনো নিরীহ ব্যক্তিবর্গকে হত্যার সীমাহীন ভীতি প্রদর্শন, সুরক্ষিত সম্পদ বিনষ্ট বা লুট, সতী-সাধবী নারীর সম্ভ্রমহানি করা। আল-মাওসূ’আহ আল-আরাবিয়্যাহ আল-‘আলামিয়্যাহ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ইরহাব (সন্ত্রাস) হচ্ছে ভীতি সঞ্চারের জন্য বল প্রয়োগ করা অথবা বল প্রয়োগের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন করা। রাবিত্বাতুল আলামিল ইসলাম’ পরিচালিত ‘ইসলামী ফিক্বহ কাউন্সিল’ ১৪২২ হিজরীতে মক্কায় অনুষ্ঠিত ১৬তম অধিবেশনে সন্ত্রাসের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা নির্ধারণ করে, কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র কোন মানুষের ধর্ম, বুদ্ধিমত্তা, সম্পদ ও সম্মানের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে যে শত্র“তার চর্চা করে তাকে সন্ত্রাস বলে”। এ সংজ্ঞা সব ধরণের নীতিবহির্ভূত ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন, ক্ষতিসাধন, অন্যায় ও বিচার বহির্ভূত হত্যা, অপরাধমূলক হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে একক ও সমষ্টিগতভাবে পরিচালিত যে কোন ধরণের অন্যায় কর্ম, সশস্ত্র হামলা, চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, রাহাজানি, ভীতিকর ও হুমকিপূর্ণ কাজ এবং এবং লোকজনের জীবন, স্বাধীনতা, নিরাপত্তাকে বিঘিœত করে, জনজীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে এমন কর্মকান্ডকে শামিল করে। তাছাড়া পরিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টি, ব্যক্তিগত ও জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট বা প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করাও সন্ত্রাস হিসাবে গণ্য হবে। ১৯৮৯ সালে আরব দেশসমূহের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ প্রদত্ত সংজ্ঞা হচ্ছে- সহিংসতা সৃষ্টিকারী বা হুমকি-ধমকি প্রদানকারী এমন সব কাজ যা দ্বারা মানবমনে ভীতি-আতঙ্ক, ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি হয়। তা হত্যাকান্ড, ছিনতাই, অপহরণ, গুপ্তহত্যা, পণবন্দী, বিমান ও নৌজাহাজ ছিনতাই বা বোমা বিস্ফোরণ প্রভৃতির যে কোনটির মাধ্যমে হোক না কেন। এছাড়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংঘটিত যেসব কাজ ভীতিকর অবস্থা ও পরিবেশ, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে (তাও সন্ত্রাস)”। ইৎরঃধহহরপধ জঊঅউণ জঊঋঊঘঈঊ ঊঘঈণঈখঙচঊউওঅ তে সন্ত্রাস- এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ঞবৎৎড়ৎরংস ঃযব ংুংঃবসধঃরপ ঁংব ড়ভ ারড়ষবহপব ঃড় পৎবধঃব ধ মবহবৎধষ পষরসধঃব ড়ভ ভবধৎ রহ ধ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ ধহফ ঃযবৎবনু ঃড় নৎরহম ধনড়ঁঃ ধ ঢ়ধৎঃরপঁষধৎ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ড়নলবপঃরাব. একটি বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করার সুসংগঠিত পন্থাই হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ”। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ঋইও সন্ত্রাসকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে, ঞযব ঁহষধভিঁষ ঁংব ভড়ৎপব ধহফ াধষবহপব ধমধরহংঃ ঢ়বৎংড়হং ড়ভ ঢ়ৎড়ঢ়বৎঃু ঃড় রহঃরসরফধঃব ড়ৎ পড়বৎপব ধ মড়াবৎহসবহঃ, ঃযব পরারষরধহ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ, ড়ৎ ধহু ংবমসবহঃ ঃযবৎবড়ভ, রহ ভঁৎঃযবৎধহপব ড়ভ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ড়ভ ংড়পরধষ ড়নলবপঃরাবং (২৮. ঈ.ঋ.জ. ঝবপঃরড়হ ০.৮৫) অর্থাৎ- সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কোন সরকার, বেসকারি জনগণ বা অন্য যে কোন অংশকে ভীতি প্রদর্শন বা দমনের জন্য ব্যক্তিবর্গ বা সম্পদের উপর অবৈধ শক্তি প্রয়োগ বা সহিংস ব্যবহারকে সন্ত্রাস বলা হয়। যে কর্মকান্ড সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, জান-মালের ক্ষতি সাধন, দেশ ও সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি, শান্তি ও নিরাপত্তা ক্ষুণœ, স্থাপনা ও স্থাপত্য ধ্বংস এবং সর্বস্তরের নাগরিকদের আতঙ্কিত করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির সম্মুখীন করে তাকে বলা হয় সন্ত্রাস। মোটকথা যে কর্মকান্ড জনগণের মাঝে ভয়-ভীতি ও আতংকের সৃষ্টি করে এবং জানমালের ক্ষতি সাধন করে তাই সন্ত্রাস এবং যে বা যারা এসকল কর্মকান্ডের সাথে জড়িত তারাই সন্ত্রাসী।
ইসলামী আইনের প্রধান উৎস আল-কুরআনুল কারীমে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ দুইভাবে এসেছে: শাব্দিক অর্থে ও পারিভাষিক অর্থে। সন্ত্রাস-এর আরবী প্রতিশব্দ ‘ইরহাব’ কে ভিত্তি ধরে শাব্দিক অর্থ হলো- প্রথমত: আল্লাহকে ভয় করা অর্থে এর শব্দমূলের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। যেমন: আল্লাহ বলেন: “মূসার ক্রোধ যখন প্রশমিত হলো তখন সেগুলো তুলে নিলো। যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের জন্য তাতে যা লিখিত ছিল মধ্যে ছিল পথনির্দেশ ও রহমত।” অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন: “হে বনী ইসরাঈল! আমার সেই অনুগ্রহকে তোমরা স্মরণ কর যা দ্বারা আমি তোমাদেরকে অনুগৃহীত করেছি এবং আমার সঙ্গে তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করব। আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর।” আল্লাহ অপর এক আয়াতে উল্লেখ আছে, “আল্লাহ বললেন, তোমরা দুই ইলাহ গ্রহণ কর না; তিনিই তো একমাত্র ইলাহ। সুতরাং আমাকেই ভয় কর”। (অসমাপ্ত)