২১’র চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশ

235

মোঃ নূরুল ইসলাম মজুমদার

২১শে ফেব্র“য়ারি কী কারণে উদযাপন করব অথবা ২১শে ফেব্র“য়ারি দিবসটির তাৎপর্য জানতে হলে ফিরে যেতে হবে অতীত থেকে দূর অতীতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে কী ঘটেছিল, সর্বপ্রথমেই তা আলোচনা করতে চাই, আমরা জানি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে তৎকালীন পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত ডমিনিয়ন রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। তখন পাকিস্তানের ২টি অংশ ছিল, ১টি অংশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান, অপরটির নাম পশ্চিম পাকিস্তান। অনেক আশা আকাঙ্খার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও অল্প কিছু দিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। কী কারণে একটি স্পর্শকাতর ২১শে ফেব্র“য়ারি উদ্ভব হলো তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠির অদূরদর্শীতা এবং বাঙালি জাতিকে হেয় চোখে দেখা এবং রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর মধ্যে দুই অঞ্চলের বৈষম্যই এর মূল কারণ। পাকিস্তানীরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি বলেই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। যেহেতু ইতিহাসের কথা উল্লেখ করেছি সেহেতু আরও একটু অতীতের দিকে তাকাতে হয়।
এ পর্যায়ে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কিত কিছু বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই যে, পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের স্বাধীনতা লাভের পূর্ববর্তী ১৯০ বৎসর ব্রিটিশরা, ভারতবর্ষকে শাসন করে, তাও এক করুণ ইতিহাস। ফিরে দেখি কি ঘটেছিল অতীতে, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে কিছু সংখ্যক বেঈমান এবং বিশ^াস ঘাতকদের জন্য, বাংলার শেষ নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পতন ঘটে। পরবর্তীতে ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণ ব্রিটিশ শাসন মেনে নিতে পারেনি, তারা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ব্রিটিশ শাসনের ঠিক ১০০ বৎসর পর ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, কিন্তু অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হওয়ায় বিদ্রোহী সিপাহীদেরকে ব্রিটিশরা অমানুষিক নির্যাতন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে। কিন্তু তারপরও কি? ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে জনগণকে বিরত রাখতে পেরেছে? ‘পারেনি’।
পরবর্তীতে ২য় বিশ^যুদ্ধের সময় পক্ষে-বিপক্ষে অনেক ঘটনা ঘটে, তাও এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৪৫ সালে ২য় বিশ^যুদ্ধ শেষ হয় এবং ব্রিটিশরা যুদ্ধত্তোর ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৮ হাজার মাখলুকাতের মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ মানুষের মধ্যে জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা আছে বলেই, মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায় এবং তার মৌলিক অধিকার ভোগ করতে চায়। মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায় এবং তার মৌলিক অধিকার ভোগ করতে চায়। মানুষ যখন রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে জাতিগত এবং সম্প্রদায়গতভাবে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন মানুষ তার অধিকার আদায় এবং স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার হয়ে উঠে।
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের রাজধানী ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। ঐ সময়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্র প্রধানের পদবী ছিল গভর্নর জেনারেল। গভর্নর জেনারেলের নাম ছিল কায়েদ আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করতেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ঐ সময়ে ২১শে মার্চের আয়োজিত রমনা রেসকোর্সের জনসভায় এবং ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তার ভাষণে ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। উক্ত ঘোষণা বাঙালি ছাত্র-জনতা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে এবং প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, যাহা সমুদ্রের ঢেউ এর মত, আকাশে বিদ্যুৎ চকমানোর মত, উত্তাল হয়ে উঠে আকাশ-বাতাস, গর্জে উঠে এদেশের ছাত্র-জনতা। জিন্নাহ সাহেবের ঘোষণা মানি না, মানব না। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, এ আন্দোলন বিস্ফোরণের মত ছড়িয়ে পড়ে গ্রামেগঞ্জে। অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে আন্দোলন।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বাঙালি ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল সহকারে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠি আন্দোলনকে দমানোর জন্য সংঘাতের পথ বেছে নেয়, ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষ থেকে আদৃষ্ট হয়ে জেলা প্রশাসক মিষ্টার কোরেশী পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। পুলিশ আনুমানিক ৩ টার পর নিরীহ ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালায়। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। শহীদ হন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল, বকরত, সালাম, জব্বার, সফিক, রফিক সহ নাম না জানা আরো অনেকে। একই সাথে অগণিত ছাত্র-জনতা আহত হয়। ভাষা আন্দোলন শুধু হত্যাই নয়, হাজার হাজার ছাত্র জনতাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। যাদের ত্যাগ তিতিক্ষা এবং জীবনকে উৎসর্গ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বপিত হয়। তাদেরকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৬, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, এ যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা, আজকের এ বাংলাদেশ। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারির পরপরই এ দেশে গড়ে উঠে অসংখ্য শহীদ মিনার।
২১শে ফেব্র“য়ারিকে আমরা শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে থাকি। উক্ত দিবসটিকে অমর করে রাখার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে যে সকল কর্মসূচি পালিত হয় তা হল দিবসের সূচনা লগ্নে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, কালো ব্যাজ ধারণ, শহীদদের সম্মানার্থে খালি পায়ে প্রভাত ফেরী, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি, ছড়া, গল্প ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এভাবেই উদযাপিত হয় মহান ২১শে ফেব্র“য়ারি।
মহান শহীদ দিবস ও বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে আরোও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার জন্য কানাডায় বসবাসরত রফিক ও সালাম নামে ২ যুবক ইউনেস্কো সহ বিভিন্ন স্থানে ২১শে ফেব্র“য়ারি শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে দাবী উত্থাপন করেন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তা সানন্দে গ্রহণ করে যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য তার সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে তার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ এবং সহায়তায় ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কোতে ভোটাভোটির মাধ্যমে ২১শে ফেব্র“য়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ ভোটাভোটিতে পৃথিবীর ১৮৮ সদস্য রাষ্ট্র সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি পাশ করে, সেই থেকে ২১শে ফেব্র“য়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বর্তমানে ১৯৩টি স্বাধীন দেশে পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীতে ৬৩৭০টি ভাষা রয়েছে, এর মধ্যে বাংলা ভাষাই একমাত্র ভাষা যাহা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এ জন্য বাঙালি জাতি আমরা সবাই গর্ব অনুভব করি।
আরও উল্লেখ্য যে, তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষা কায়েমের জন্য তমদ্দুন মজলিস নামের সংগঠন সহ আরো অনেক ব্যক্তি ও সংগঠনের অবদান রয়েছে। যাদের অবদানে আমাদের দেশে এবং জাতি গর্বিত তাদের সকলকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।
এ স্বীকৃতি আদায়ের পরও আমাদের অনেক কাজ বাকি রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে পৃথিবীতে আমরা আরও অনেক কিছু অর্জন করতে পারি, তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে প্রতিটি জেলায়, ভাষা শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র এবং প্রশিক্ষণ একাডেমী স্থাপন করা গেলে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষদের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠবে। ভাষা শিক্ষা গবেষণা একাডেমীতে আমাদের সন্তানেরা বিভিন্ন দেশের ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করে বিদেশে যেতে পারবে। এর বিনিময়ে আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে বিদেশী রেমিট্যান্স আসবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যাবে।
আরও একটি বিষয় নিবেদন করতে চাই যে, আমরা যাতে পৃথিবীর বুকে আরও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি এ লক্ষ্য অর্জনে জুন মাসে অনুষ্ঠিত/ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের বার্ষিক বাজেট অধিবেশনের পরিবর্তে চৈত্র মাসে এবং ১লা জুলাই আর্থিক সাল আরম্বের পরিবর্তে ১লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ থেকে কার্যক্রম শুরু করা গেলে বাঙালি জাতির জন্য আরও একটি মাইলফলক কাজ হিসেবে গণ্য হবে। প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে পৃথিবীর বুকে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।