জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার গবেষণা রিপোর্টে তথ্য প্রকাশ ॥ ’১৭ সালে সারাদেশে ৭৯৫ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার

39

কাজিরবাজার ডেস্ক :
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে ছোঁয়া পরিবহনের শ্রমিকদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন ঢাকার আইডিয়াল ‘ল’ কলেজের আইন বিভাগের মেধাবী ছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপা। পরে রূপার ঘাড় মটকে হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে রেখে যায় ঘাতকরা। শুধু তাই নয়, ১০ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে ঘটে আরেক লোমহর্ষক ঘটনা। শিশু মেয়ের ধর্ষণের বিচার না পেয়ে প্রায় দুই মাস পরে মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে জীবন দেন বাবা। ওই বছর ২৮ মার্চ বনানীর হোটেল দ্য রেইনট্রিতে জন্মদিনের পার্টিতে এসে ধর্ষণের শিকার হয় দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।
শুধু এই তিনটি ঘটনা নয়, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা বলছে, ২০১৭ সালে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৯৫ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে শিশুই ৩০০ জন। নারী ৩২০ জন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১৭ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৮ জনকে। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে দ্বিগুণ বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা। ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৪০৭ জন নারী ও কন্যা শিশু। শিশু বা তরুণী নয়, বাদ পড়ছে না প্রতিবন্ধীরাও। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা জানিয়েছে, জানুয়ারিতে কুমিল্লায় চিকিৎসা সেবা নিতে এসে ধর্ষণের শিকার হয় এক প্রতিবন্ধী নারী।
তবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ৯৬৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে ২২৪টি। বিগত বছরটিতে নারী ও কন্যাশিশুর নির্যাতন চিত্রের তথ্য অনুযায়ী সংস্থাটি জানায়, মোট ৫ হাজার ২৩৫ জন নির্যাতনের শিকার হন। সংস্থাটি মনে করে, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের অভাব, পিতৃতন্ত্র ও বৈষম্যমূলক আইন নারী নির্যাতন বাড়ার পেছনে দায়ী। শুধু ধর্ষণ নয়, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা ৭৯ ধরনের অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৪৫ ঘটনার ২০১৬ ও ২০১৭ সালের তুলনামূলক চিত্র রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করেছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চেয়ারম্যান এডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, দৈনিক জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ২০১৭ সালের, গবেষণা সেলের পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, শিশু হত্যা ও নারী নির্যাতন ছিল পুরো বছর জুড়েই। তুলনামূলকভাবে বেড়েছে ধর্ষণ ও শিশু হত্যা। পারিবারিক কোন্দলে আহত ও নিহতের সংখ্যাও এই বছর তুলনামূলক বেশি। নারী নির্যাতন, আত্মহত্যা পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো গত বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। তা জাতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। মানুষের পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়ছে, যা দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন জনিত ঘটনা ও অন্যান্য সহিংসতায় ঘটনায় মোট ২৪ হাজার ৬১৬ জন আহত ও ৬ হাজার ৬০২ জন নিহত হয়েছে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ২০১৭ সালেই শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয় ৩৫২ জন শিশু। এদের মধ্যে পিতা মাতার হাতে নিহত হয় ৪২ জন শিশু। ২০১৬ সালে শিশু হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭ জন। ২০১৭ সালে নির্যাতনের শিকার হয় ২১১ জন শিশু। ২০১৬ সালে হয়েছিল ১৯৯ জন। ২০১৭ সালে যৌতুকে বলি হয়েছেন ৬০ জন নারী। যৌতুকের কারণে আহত হয় ৬২ জন নারী। এছাড়া পারিবারিক কলহে নিহত হয় ৪০৭ জন ও আহত হয় ১২০ জন। নিহতদের মধ্যে ২৯৩ জন নারী।
সারাদেশে সন্ত্রাসী কর্তৃক নিহত ৮৯৭ জন ও আহত হয় ৫৯২ জন। ক্রসফায়ারের নামে মৃত্যু হয় ১৪৯ জনের, এর মধ্যে পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয় ১০৭ জন, র‌্যাব কর্তৃক ৩৯ জন ও অন্যান্য বাহিনী কর্তৃক ৯ জন। পুলিশ ও জেল হেফাজতে মৃত্যু হয় ৪৬ জনের। আত্মহত্যা করেছে মোট ৬৫৩ জন। এদের মধ্যে ১৯৪ জন পুরুষ ও ৪১৭ জন নারী ও ৪২ জন শিশু রয়েছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা সোহেল বলেন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, প্রেমে ব্যর্থতা ও যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে জানা গেছে। সিগমা হুদা বলেন, প্রলম্বিত বিচার পদ্ধতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এই সবকিছু মিলেই দেশের আপামর জনসাধারণের মানসিক ও মানবিক চিন্তা চেতনার অবক্ষয়ের কারণে বেড়ে গেছে সামাজিক অসন্তেুাষ। আর অসন্তোষের শিকার হয়ে এ বছর নিহত হয়েছেন ১৭১ জন, আহত হয়েছে ৫৭৮১ জন।
২০১৭ সালের বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সঙ্গে সম্প্রতিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ৩২ ধারা নিয়ে মতামত ও সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ ২৫ বছর বৃদ্ধি নিয়ে সংস্থাটির অবস্থান জানানো হয়। উদ্বেগ প্রকাশ করে সিগমা হুদা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ৩২ ধারার মাধ্যমে গণমাধ্যম ও মানুষের বাক স্বাধীনতাকে হয়রানির মুখে ফেলা হয়েছে। এই ধারায় হয়রানির শিকার হতে পারেন সাংবাদিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীগণ। তাই এই আইনটি চূড়ান্ত করার আগে সরকারের আরও একবার সতর্কতার সঙ্গে আইনটি পর্যালোচনা করার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। তাছাড়া আইনটি পাস হবার আগে বিভিন্ন স্তরে আরও আলোচনার দাবি রাখে বলে মতপ্রকাশ করে এই সংস্থা।