বিশ্ব ভালোবাসা দিবস আজ

418

কাজিরবাজার ডেস্ক :
শীতের ছোঁয়া মিলিয়ে গেল আস্তে/ফাগুন এলো আবার ভালোবাসতে…। ভালোবাসি ভালোবাসি আর ভালোবাসি। না, আর কোন কথা নয়। মুখ থেকে, বুকের গভীর থেকে শুধু বলা- ভালোবাসি। কারণ বছর ঘুরে আবারও এসেছে সেই দিন। আজ ১৪ ফেব্র“য়ারি বুধবার ভালোবাসার বিশেষ দিবস ভ্যালেনটাইন ডে। কিউপিডের তীরে বিদ্ধ হওয়ার দিন। শাশ্বত প্রেমের কাছে নত হওয়ার শুভক্ষণ। ভালোবাসার মহা অনুভূতির কাছে নিজেকে নিশ্চিন্তে সঁপে দেয়ার উপযুক্ত সময়।
ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখো- তোমার/ মনের মন্দিরে…। মনের মন্দিরে লেখা হয়েছে কি প্রিয়জনের নাম? বলা হয়েছে, ভালোবাসি? আজ বলুন। ভালোবাসার শক্তিতে সুন্দর সমাজ প্রেমময় পৃথিবী গড়ার শপথ নেয়ার দিন এসেছে।
আজ ভালোবাসার নেশায় নতুন করে বুঁদ হবে আজ বাঙালি। সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও উদ্যাপিত হবে ভ্যালেনটাইন ডে। প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অন্যকে বিভিন্ন উপহার দেবেন। মোবাইল ফোন, এসএমএস, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে চলবে ভালোবাসার আদান প্রদান।
মাত্র একদিন আগে সোমবার ছিল পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের প্রথম দিন উদ্যাপনের রেশ থাকতে থাকতেই চলে এসেছে ভালোবাসার দিন। বাসন্তী রং পাল্টে লাল রঙ্গের শহর হবে। প্রেমিকের হাত হয়ে প্রেমিকার সুবিন্যস্ত খোঁপায় উঠবে লাল গোলাপ। কবিগুরু বলেছিলেন, তোমার গোপন কথাটি, সখী রেখো না মনে/শুধু আমায়, বোলো আমায় গোপনে…। হৃদয়ের একান্ত গোপন কথাটি আজ প্রকাশ করবেন অনেকেই। প্রিয়জনের সামনে হাঁটু গেড়ে ঠিক বসে যাবেন। বলবেন, উইল ইউ বি মাই ভ্যালেনটাইন?
মনের গভীর ভাব প্রকাশ করে হাসন রাজা লিখেছিলেন, নিশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে…। ভাটি বাংলার এই লোককবির নিশা আর কাটেনি কোন দিন। বরং অনলে পুড়েছে ভেতর বাহির। কাউকে বলে তা বোঝাবার নয়। সুনামগঞ্জের অসহায় প্রেমিক কবি তাই সুর তোলেন- ধাক্ ধাক্ কইরা উঠল আগুন ধৈল আমার প্রাণে/সুরমা নদীর জল দিলে নিভে না সে কেনে…। এ আগুনকে দ্বিগুণ করতে আবারও এসেছে ভালবাসার বিশেষ দিবস। আজ ঘরে থাকা দায়। রাধারমন থেকে বললে, ‘আমি রব না রব না গৃহে বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না…।’ প্রায় একই উচ্চারণ শাহ আবদুল করিমের। তার বলাটিÑ আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা/কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া…। মনের মানুষটি ছাড়া সত্যি বাঁচা দায়। ভালবাসাহীন জীবন বিবর্ণ। আর তাই যত আকুলি বিকুলি সব ভালোবাসার জন্য।
প্রথম দিকে দিবসটি ঘিরে কিছুটা ফিস ফিস ছিল। এখন আর তা নয়। বিপুল আবেগ উচ্ছ্বলতায় কাটে বিশেষ এই দিবস। ভালোবাসা দিবসে নতুন করে দেখা দেয় চিত্ত চাঞ্চল্য। রাজপথে, ক্যাম্পাসে, পার্কে, রেস্তরাঁয় প্রকাশ্যে ও গোপনে মিলবে যুগল। শহর ঘুরে বেড়াবে। একে অন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলবেÑ নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়/ অলংকার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না…। প্রেমের কবি নজরুল তো প্রিয়ার চোখে হারিয়ে গিয়েছিলেন। গুন গুন করে গেয়েছিলেনÑ চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এ নয়ন পানে/জানিতে নাইকো বাকি, সই ও আঁখি কি যাদু জানে…। আজ সারা জীবন প্রিয় মানুষটির পাশে থাকার শপথ নেয়ার দিন। নজরুলের ভাষায়Ñ এসো তুমি একেবারে প্রাণের পাশে/ যাও মিশে গো আমার প্রাণে, আমার শ্বাসে…। আর যারা একলা মানুষ তারা মনের মানুষটিকে ‘ভালবাসি’ বলার সব চেষ্টা করবেন। পাশ্চাত্যের অনুকরণে মেয়েদের প্রশ্নটি হবেÑ উইল ইউ বি মাই ভ্যালেনটাইন? যারা সাহস করতে পারবেন না তারা অপেক্ষা করে থাকবেন, হঠাৎ কিছুর জন্য। গুন গুন করে গাইবেনÑ হাজার লোকের মাঝে রয়েছি একেলা যে-/ এসো আমার হঠাৎ-আলো, পরাণ চমকি তোলো…। কারও কারও ভেতরে ভালবাসার সকল অনুভূতি তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু কার জন্য ব্যাকুল মন সেটি আর বোঝা হয় না। কবিগুরুকে তাই হয়তো লিখতে হয়Ñ যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম/ কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম…। আর যারা নামটি জানেন কিন্তু তাকে বলতে পারেন না ভালবাসি সেই তাদের ব্যথা তুলে ধরে কবিগুরু বলেছেনÑ আমি যে আর সইতে পারি নে/ সুরে বাজে মনের মাঝে গো, কথা দিয়ে কইতে পারি নে। অন্যভাবে বললে, লাগে বুকে সুখে দুখে কত যে ব্যথা/কেমনে বুঝায়ে কব না জানি কথা…। এখানেই শেষ নয়। ভ্যালেনটাইন ডে মনের পুরনো অনেক ব্যথা জাগিয়ে তুলে। ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে’ ‘ঝরা ফুল’ কুড়ান কোন কোন প্রেমিক প্রেমিকা।
অবশ্য এখন স্থূল প্রেমও কম দেখা যায় না। তরুণ-তরুণীরা যখন তখন প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন এবং বিনা কারণে কিংবা সামান্য কারণে বলে দিচ্ছেÑ ব্যাকআপ! নতুন প্রেমিক কিংবা প্রেমিকাও জুটে যাচ্ছে তৎক্ষণাত। শুরু হয়ে যাচ্ছে ভালবাসাবাসি! তবে আজ এইসব প্রেমের কথা হবে না। সুন্দর আর শ্রেষ্ঠ প্রেমগুলোর কথা বার বার স্মরণ করবে মানুষ। আজ সবটুকু শততা নিয়ে একে অন্যকে বলবেন ‘এভরিথিং আই ডু আই ডু ইট ফর ইউ।’ শিরি- ফরহাদ, লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রুমিও-জুলিয়েটের মতো অমর হওয়ার স্বপ্নে উদ্যাপিত হবে ভ্যালেনটাইন ডে।
যতদূর তথ্য, এই ভ্যালেন্টাইন ডে উদ্যাপনের শুরুটা প্রাচীন রোমে। তখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিয়ের দেবী জুনোকে সম্মান জানানোর পবিত্র দিন। দিবসটি অনুসরণ করে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করা হতো লুপারকেলিয়া উৎসব। সে সময় তরুণ-তরুণীদের খোলামেলা দেখাসাক্ষাতের তেমন সুযোগ ছিল না। জীবনসঙ্গী নির্বাচনে তাদের জন্য ছিল লটারির মতো একটি আয়োজন। উৎসবের সন্ধ্যায় বেশ কিছু কাগজের টুকরোয় তরুণীদের নাম লিখে একটি পাত্রে রাখা হতো। একটি করে কাগজের টুকরো তুলত তরুণরা। কাগজের গায়ে যার নাম লেখা থাকত তাকে সঙ্গী হিসেবে পেত তরুণটি। কখনও কখনও ওই দু’জনের মিলনের ক্ষণ এক বছর স্থায়ী হতো। কখনও কখনও তা গড়াত বিয়েতে। অপর গল্পটি এ রকমÑ সম্রাট ক্লদিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কম ভর্তি হওয়ায় ক্লদিয়াস উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি ধারণা করতেন, পরিবার ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই যুদ্ধে যেতে রাজি হতো না পুরুষরা। ফলে ক্লদিয়াস সমগ্র রোমে সব ধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সে সময় রোমে ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি এবং সেন্ট ম্যারিয়াস খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতেন। বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা করতেন। এ অপরাধে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেফতার করে করাগারে নিক্ষেপ করেন। বন্দী থাকা অবস্থায় অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেত। জানালা দিয়ে তার উদ্দেশে চিরকুট ও ফুল ছুড়ে দিত। হাত নেড়ে জানান দিত, তারা যুদ্ধ নয়, ভালবাসায় বিশ্বাস রাখে। এদের মধ্যে একজন আবার ছিল কারারক্ষীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতেন। এক পর্যায়ে তারা একে অপরের বন্ধু হয়ে যান। ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে লেখা ছিল ‘লাভ ফোরাম ইয়র ভ্যালেন্টাইন’। বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সে দিনই ভ্যালেনটাইনকে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি। কালের ধারাবাহিকতায় আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এর কেন্দ্রীয় চরিত্রটি হয়ে ওঠেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন।