আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…..

57

জেড.এম. শামসুল :
মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করার দাবীটি দিন গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আন্দোলন সংগ্রাম তত প্রকট আকার ধারণ করে। অব্যাহত আন্দোলন সংগ্রামের বিস্তার ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষাকে হরণ করতে বিদেশী চক্র ও তার ভক্তরা কম করেনি।
উর্দ্দু ভাষার পক্ষে যুক্তি কম দেখায়নি। কিন্তু বাঙালি জাতি সব প্রবঞ্চনার উর্ধ্বে থেকে আন্দোলন সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার বিভিন্ন কর্মসূচী প্রদান অব্যাহত রাখে। সেই ১৯৪৭ সালের চলমান আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় যত বাধা বিপত্তি আসুক না কেন, কঠোর পরিস্থিতির মধ্যে হামলা-মামলা ও গ্রেফতার এড়িয়ে বাংলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কার্যক্রম চালিয়ে যায়। সেই ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লিয়াকত আলী খান কর্তৃক পাকিস্তান গণপরিষদ’র সামনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের মূলনীতি পেশ করা হয়। মূল নীতিতে কমিটির চেয়ারম্যান তমিজুদ্দিন খান এবং ভাইস চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী সহ ২৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে রাষ্ট্রীয় কর্মধারা নির্ধারণের কর্মসূচীর মধ্যে ছিল সরকারের সংরক্ষিত নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার নামে দেশরক্ষা, মিলিটারী, পররাষ্ট্র, শিল্প উন্নয়ন, বিমান, বাণিজ্য, ব্যাংকিং ও কারেন্সি, খনি সহ ৬৭টি বিশেষ ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে রাখার কথা বলা হয়। এতে একমাত্র উর্দ্দু রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা হয়। এ সময় শাসনতন্ত্রের মূলনীতির তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক আবুল কাশেম সহ নেতৃবৃন্দ পাক পার্লামেন্টের চেয়ারম্যান তমিজুদ্দিন খানের কাছে প্রতিবাদ পাঠান এবং সভায় দেশে এরূপ নীতির প্রতিবাদে সভা সমাবেশ করার আহবান জানান। পরের দিন থেকে সারা পূর্ববঙ্গে আন্দোলন সংগ্রাম উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ১৯৫০ সালের ২ অক্টোবর করাচিতে গণপরিষদ’র মূলনীতি নির্ধারণ কমিটির সভায় ডি,কে দত্তের সংশোধনী প্রস্তাবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এবং বাংলা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবী করা হয়। এ বছরের ৫ অক্টোবর পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের খসড়া মূলনীতির সুপারিশ প্রত্যাহার করার দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে আব্দুল জব্বারের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ছাত্র নেতৃবৃন্দ এরূপ প্রতারণামূলক শাসনতন্ত্রের খসড়া মূলনীতি প্রত্যাহার করার দাবী জানান এবং আন্দোলন সংগ্রাম আরো বেগবান করার জন্যে সকলের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। ১৯৫০ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকা শহরের মত চট্টগ্রাম শহরে আন্দোলনের প্রকটতা বেড়ে যায়। এদিন চট্টগ্রামে তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, নিখিল পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন, শিক্ষক সমিতি, রেলওয়ে এমপ্লয়িজলীগন সহ অন্যান্য সংগঠন পাকিস্তানের গঠনতন্ত্রের মূলনীতির প্রতিবাদে ও উর্দ্দু ভাষার পরিবর্তে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করার জোরালো দাবী উত্থাপন করা হয়। এদিকে বাংলা ভাষা বিরোধী এ সম্মেলনে যুক্তিপ্রদর্শন করে আরবীকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় রূপান্তরিত করার দাবী জানান। আরবীকে রাষ্ট্রভাষা রূপে ব্যবহারের জন্য তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। কারণগুলোর মধ্যে ১। মুসলমানদের অধঃপতনের সময়ে যে ভাষার প্রচলন হয় সেটি উদ্দু অথচ উর্দ্দু মুসলমানদের মান গৌরব সূচনা করে, ২। পাকিস্তানের স্বাভাবিক বা জাতীয় ভাষা উদ্দু নয়, ৩। উর্দ্দুবাষা রাষ্ট্রীয় ভাষায় রূপান্তরিত হলে পাকিস্তান পৃথিবীর মুসলমানদের ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। কিন্তু আরবী ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষায় ব্যবহার করলে পাকিস্তান সমস্ত মুসলমান জগতের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করে চলতে পারবে। বাংলা ভাষাকে পরাস্ত করতে পাকিস্তানী চক্ররা বিভিন্নভাবে নানা কৌশল প্রয়োগ করতে থাকে। ধর্মের নামে ফায়দা লুটা সহ পূর্ববঙ্গের সাধারণ মুসলমানদের দুর্বল স্থানে আঘাত করে তাদের স্বার্থ রক্ষার প্রচেষ্টায় মত্ত হয়ে উঠে। কিন্তু বাঙালি সচেতন মহল সহ ছাত্র সমাজ হাল ছাড়েনি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অব্যাহত রাখে।