আহত প্রেম

60

॥ আবু মালিহা ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
ওদিকে মনিরা তার বাড়ীতে বসে, শুয়ে ও চঞ্চলতা করে দিন কাটাচ্ছে ২৬ মার্চের দিনের জন্য। কারণ তার শিশির ভাইয়ার স্কুলে এতো বিরাট অনুষ্ঠানে সে কি না এসে থাকতে পারে। বাবাকে বলে রেখেছে ঐদিন সে সকালেই তার মাকে নিয়ে চলে আসবে শিশিরদের বাড়ী। তারপর সকাল দশটার আগেই স্কুলে পৌছে যাবে শিশিরের ছোট বোন নাতাশাকে সাথে নিয়ে। নাতাশাও ঐ স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। ভাইয়ার মতো এতো মেধা না থাকলেও মোটামুটি পড়াশুনায় ভাল। মনিরার দু’বছরের ছোট, মনিরার সাথে তারও খুব ভাব। দু’জনে অনেক গল্প ও খেলাধূলা করে এক সাথে। কোথাও যেতে হলে মনিরা তাকেই সাথে নেয়। তাই ২৬ মার্চও তাকে সাথে নিলো মনিরা। বেশ সুন্দর ও পরিপাটি করে সেজে গুঁজে স্কুলের দিকে রওনা দিলো যথা দিনটিতে। শিশিরদের বাড়ী থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের পথ। জমিনের আইল ঘেঁষে বনের ঝোপঝাড় মাড়িয়ে আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে স্কুলে যেতে ভালই লাগে। মাঝে মধ্যে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা এদিক-ওদিক বিক্ষিপ্ত ভাবে উড়াউড়ি করছে। দূর আকাশে চিল উড়ছে তার বিস্তৃত ডানা মেলে। মনে হচ্ছে, দিগন্তে স্বাধীনতার ডানা মেলে আপন মনে উড়ে বেড়াচ্ছে নীল চাদোয়ার তলে পরম সুখে। কোন অজানার চির সাথীকে খুঁজতে। আপন মনে কখন যে কল্পনার স্বপ্নীল ভাবনা তার মনে এসে বাসা বুনেছে চলতে চলতে সে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ করে ভাবনায় ছেদ পড়লো নাতাশার ডাকে। বললো দেখ মনিরা আপা দূরে কতো সুন্দর চিল আকাশে উড়ছে। ওরা কতো স্বাধীন তাইনা! মনিরা বললো হ্যাঁরে বোন! ওরা সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন। কোন বাঁধা নেই। মনে মনে যেথা খুশি সেথা যেতে পারে। ওরা যেন প্রকৃত স্বাধীনতার খোঁজ পেয়েছে, এমনই ভাবনাতে ওরা প্রায় স্কুলের কাছে চলে এলো। এসেই দেখলো বিশাল আয়োজন, বিশাল প্যান্ডেল। চারদিকে হরেক কালারের নিশান বানিয়ে দড়ি দিয়ে অনুষ্ঠান স্থল ঘিরে রেখেছে অতিথিদের বসার জায়গা। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আলাদা ভাবে বসার জায়গা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদা ভাবে বসার জায়গা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল প্রাঙ্গণের সামনে শামিয়ানা টাঙ্গানো মাঠে বসার জায়গা করা হয়েছে। আনন্দ কোলাহলে সবাই মেতে রয়েছে। স্কুলের গৌরবময় ঐতিহ্য আর ভাল রেজাল্টের সুখবর সবার কাছে পৌছে দিতেই অনুষ্ঠানের এ বিশাল মহড়া। দু’তিন গ্রাম থেকে ইতোমধ্যে অনেক লোকের সমাগম হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল ১০টায়। প্রধান মেহমান জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আসবেন ঠিক ১১টায়। তাই যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে প্রায় সব ঠিকঠাক। আমোদ প্রিয় ছেলেমেয়েরা এদিক-ওদিক ঘুরাফেরা করছে। সাজানো স্কুলকে দেখছে এবং নতুন নতুন মানুষদের সমাগমের পরিবেশ আনন্দের সাথে উপভোগ করছে।
যথাসময়ে মঞ্চে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে রেজওয়ানুল করিম ঘোষণা দিলেন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার। সবাইকে ধীরস্থির ভাবে বসে পড়ার জন্য অনুরোধ করলেন। এবং ঘোষণা করলেন প্রধান অতিথি কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান স্থলে এসে হাজির হবেন। প্রথমেই কুরআন থেকে তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলেন এবং এই তেলাওয়াতে অংশগ্রহণ করল স্কুলের মেধাবী ছেলে শিশির। অপূর্ব কন্ঠে সূরা রাদের ৮ থেকে ১০ আয়াত পড়ে শুনালো এবং সাথে সাথে বাংলা তর্জমা করেও শুনালো। ভাব গম্ভীর পরিবেশে সবাই নিরবে শুনলো তার তেলাওয়াত ও তার অনুবাদ। তারপর শুরু হলো শিক্ষকদের বক্তব্য এবং স্কুলের ঐতিহ্য তুলে ধরা। ছাত্র ছাত্রীদের মনোযোগের সাথে পড়াশুনার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চায় তারা অনেক এগিয়ে এ ব্যাপারে কিছু সাফল্যও তুলে ধরা হলো। বিশেষ করে শিশির এর পুরস্কার প্রাপ্তি এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার দক্ষতা স্কুলের সুনামকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বলে শিক্ষকদের মুখে প্রশংসা ঝরে পড়লো। মেয়েদের অংশে বসে বসে মনিরা সে সব শুনছিল এবং মনে মনে আনন্দে আপ্লুত হচ্ছিল। তার চেহারাটা উজ্জ্বল হচ্ছিল এবং ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হচ্ছিল। একে একে বক্তৃতার পালা শেষ হচ্ছে। এখন প্রধান অতিথি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নূরুল হক’র বক্তব্য শুরু হবে। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান চলছে। এর মধ্যে দু’একজন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের বক্তব্যও দেয়া হয়েছে। প্রধান অতিথিকে উপস্থাপক তার মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেয়ার জন্য আহ্বান করলেন। তিনি ধীর স্থির ভাবে মঞ্চে উঠে অত্যন্ত আবেগ তাড়িত ভাবে সবাইকে সম্বোধন করে সালাম দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করলেন। বক্তব্যে স্কুলের সার্বিক উন্নতি ও শিক্ষকদের কর্মযজ্ঞ ও ছাত্র-ছাত্রীদের আন্তরিকভাবে পড়াশুনা করে ভাল রেজাল্ট করা ও পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হওয়ার সকল শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ করে তিনি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে শিশিরের তেলাওয়াত, উপস্থাপনা ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা রাখার ব্যাপারে তার আন্তরিকতা দেখে তিনি খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই তিনি তাকে শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ারও অঙ্গিকার করলেন এবং স্কুলের যাবতীয় সহযোগিতার ব্যাপারে তার আন্তরিকতার কোন ঘাটতি হবেনা বলেও আশ^াস দিলেন। প্রধান শিক্ষক জহুর আলী সভাপতির ভাষণ দিলেন এবং প্রধান অতিথিকে ধন্যবাদ জানালেন তিনি স্কুলে এসে গৌরবান্বিত করার জন্য। অনুষ্ঠান শেষে আপ্যায়নের পর শিক্ষা কর্মকর্তাকে আন্তরিক বিদায় জানালেন।
পার হয়ে গেলো আরো দু’বছর। মনিরা এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। পড়াশুনা মোটামুটি ভালই চলছে। প্রত্যাশা আছে ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকতা শুরু করবে। কারণ গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা কম। সে চায় গ্রামের প্রতিটি ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে গ্রামকে সুন্দর করুক। শিক্ষিত হোক মনের দিক থেকে সবাই সুন্দর ভাবে গড়ে উঠুক। সবুজ শ্যামল গ্রামকে আরো মায়াময় করে তুলুক। ভবিষ্যতে তার গ্রামকে আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। মনিরার মা-বাবাও তার পড়াশুনার আগ্রহ দেখে আর বাঁধা দেয়না। মেয়ে মানুষ শিক্ষায় আগ্রহী হয়েছে দেখে মা-বাবার মনে অনেক আনন্দ। শুধু মনিরাই নয় তার গ্রামের আরো অনেক মেয়ে তার মতো পড়াশুনায় আগ্রহী হয়েছে। স্কুল কলেজে পড়ছে। তাই মনিরাও ভবিষ্যতে আশার আলো দেখছে। আর সে ব্যাপারে শিশিরের অবদান অবশ্যই আছে। কেননা পড়াশুনার প্রতি প্রথম আগ্রহ সেই তাকে দিয়েছে। আর অংক করার ছলে মনের গভীরে প্রবেশ করেছে শিশিরের। কিন্তু এসব এখন আর ওকে মনে করতে পারছেনা। ভিতরে ভিতরে গুমড়ে কেঁদে ওঠে। মাঝে মধ্যে পাগল পারা হয়ে যায় শিশিরের জন্য। আজ তিন বৎসর হয় শিশির বিদেশ চলে গেছে উচ্চ শিক্ষার্থে বিশ^বিদ্যালয়ে ইংরেজীতে মাষ্টার্স করার পর স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডন চলে গেছে উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার জন্য। এবং বলে গিয়েছিল তাকে মনে রাখার জন্য এবং মাঝে মধ্যে পত্র লেখার জন্য। প্রথম প্রথম বছর খানেক সে ভাবে চলছিল। এরপর থেকে আর তার যোগাযোগ বন্ধ। মনিরা ভাবলো হয়তো পড়াশুনায় ব্যস্ত বলে সময় করতে পারছে না।
(অসমাপ্ত)