জাফলং-বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি ॥ মানুষখেকো গর্ত কেড়ে নিল ১২ মাসে ১৩ প্রাণ

91

কে.এম.লিমন গোয়াইনঘাট থেকে :
শারপিন টিলা, লোভাছড়া, জাফলং ও বিছনাকান্দিতে মানুষের নিজ হাতে খোড়া বড় বড় পাথর উত্তোলনের গর্তে প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। এ দুর্ঘটনায় একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও কোন ভাবেই বন্ধ হচ্ছে না অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন।
এরই ধারাবাহিকতায় অবৈধ পন্থায় ও অপরিকল্পিত ভাবে পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং ও বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি এলাকায় দিনের পর দিন ভারী হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এ দুটি পাথর কোয়ারি এলাকায় পাথর তুলতে গিয়ে মানুষখেকো গর্ত কেড়ে নিল ১২ মাসে ১৩ প্রাণ। পাথর তুলতে গিয়ে মাটি চাপা পড়ে এই ১৩ শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অবৈধ কোয়ারি মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর কোন ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। যার পরনায় পাথর খেকো চক্রের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। আর সেই অবৈধ পাথর উত্তোলনের গর্তে পাথর তুলতে গিয়ে মাটি চাপা পড়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে দরিদ্র পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিগুলো। গত মঙ্গলবার বিকেলে জাফলংয়ের মন্দিরের জুম এলাকায় পাথর উত্তোলনের একটি গর্তে পাড় ধসে ৭ শ্রমিক মাটি চাপা পড়ে। এ সময় গর্ত থেকে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার মিরপুর গ্রামের মফিজ উল্লাহর ছেলে নুর মিয়া (৫০), হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার বানেশ্বর বিশ্বাসের পাড়ার মৃত ইব্রাহিম আলীর ছেলে জহুর আলী (৬৫), জহুর আলীর ছেলে মুজাহিদ মিয়া (২২) মেয়ে সাকিরুন বেগম (২৬) সহ ৪ জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় আরও তিনজনকে। আহতদের মধ্যে সাদেক মিয়া (৪০) নামে এক শ্রমিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতে মারা যান। এর আগে গত বছরের ১৩ নভেম্বর একই স্থানে পাথর তুলতে গিয়ে মাটি চাপা পড়ে নিহত হয় নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি থানার শ্যামপুর এলাকার রঞ্জিত দাসের মেয়ে চম্পা দাস (১৭) নামের এক কিশোরী। একই বছরের ১৬ মার্চ জাফলংয়ের নয়াবস্তি এলাকার পিয়াইন নদীর তীরে পাথর কোয়ারিতে মাটি চাপা পড়ে সিলেট সদর উপজেলার টুকের বাজার এলাকার নেখয় মিয়ার ছেলে আকরাম (৪০) ও একই এলাকার আব্দুল খালেক মিয়ার ছেলে লেছো মিয়া (২৫) মারা যান। এর আগে ১০ ফেব্র“য়ারি বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি এলাকায় পাথর তুলতে গিয়ে মাটি চাপা পড়ে মারা যান সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গুলেরগাঁও গ্রামের নজির আলীর ছেলে জাকির হোসেন (২০), ওয়াতির আলীর ছেলে তুলা মিয়া (২৫) এবং দিরাই উপজেলার পরিমল (২৫) নামের তিন শ্রমিক। এর ঠিক নয়দিন পর ১৯ ফেব্র“য়ারি জাফলংয়ের সংগ্রাম বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় চুনা কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন করার সময় সিলেটের কোম্পাণীগঞ্জ উপজেলার তেলিখাল গ্রামের মদরিস আলীর পুত্র কামরুজ্জামান (২৮) ও একই এলাকার জিয়াদুর রহমান’র পুত্র তাজ উদ্দিন (৩০) নামের দুই শ্রমিক মাটি চাপা পড়ে মারা যান।
অবৈধ পন্থায় পাথর উত্তোলনে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পাথর খেকো চক্র দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছে পরিবেশ ধ্বংস করে পাথর উত্তোলন কার্যক্রম। ফলে প্রাশই ঘটছে শ্রমিকদের প্রাণহানীর ঘটনা। মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়কারী শাহ শাহেদা আক্তার বলেন পাথর কোয়ারিতে শ্রমিকদের প্রাণহানীর জন্য সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী হচ্ছে প্রশাসন। অবৈধ পন্থাবলম্বন করে পাথর উত্তোলন ঠেকাতে প্রশাসনের অনিচ্ছার কারণেই পাথর তুলতে গিয়ে শ্রমিকদের প্রাণহানীর মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে। তাই এর সকল দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে বলে জানান তিনি।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিত কুমার পাল বলেন জাফলংয়ের মন্দিরের জুমপার এলাকা থেকে অবৈধ পন্থায় পাথর উত্তোলন না করতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি অবৈধ গর্তগুলো ভরাট করার জন্য (শনিবার) পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। আইন অমান্য করে অবৈধ ভাবে পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সাথে অবৈধ ভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ধারাবাহিক টাক্সফোর্সের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।