আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ সিলেটে ৫টি সহ ৬২ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি জামায়াতের

94

কাজিরবাজার ডেস্ক :
হাইকোর্টের নির্দেশে দলের নিবন্ধন স্থগিত থাকলেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতে ইসলামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত দলটি ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেবে, না স্বতন্ত্র প্রার্থী দেবে, সে বিষয়টিরই সুরাহা হয়নি। সারা দেশে ৬২টি আসনে দলীয় প্রার্থীদের প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেও কেবল সিলেট জেলার ৬টির আসনের ৫টিতেই মনোনয়ন চায় জামায়াত। ইতোমধ্যেই সিলেট জেলার ৫টি আসনে কে, কোথায় প্রার্থী হবেন। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। পাশাপাশি মৌলভীবাজারে ২টি, সুনামগঞ্জে ১টি আসনে সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থীও ঠিক করেছে জামায়াত। দলটির সিলেট জেলা জামায়াতের নেতারা জানিয়েছেন, জোটের সমর্থন পেলেই সিলেট বিভাগের মোট আট আসনে মনোনয়ন দেবে দল। তবে, একই জেলায় জামায়াতের এই আসন দাবির বিষয়টিকে ‘বিলাসিতা’ হিসেবে দেখছেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই প্রস্তুতি অবাস্তব। দলীয় ও সাংগঠনিক অবস্থান বিবেচনা করে বিএনপি প্রভাবিত সিলেট এলাকায় জামায়াতের আসনচিন্তা বাড়াবাড়িও।
জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, সিলেট সদর আসনে দলের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানকে (কারাবন্দি) মনোনয়ন দিতে চায় দলটি। এক্ষেত্রে এই আসনে বিএনপির জেলা ও মহানগরের নেতারা খালেদা জিয়া বা ডা. জোবায়দা রহমানকে প্রার্থী দেখতে চান। ফলে, জামায়াত অনেকটা সিলেট বিএনপির মতের বাইরে গিয়েই শফিকুর রহমানের প্রার্থিতার বিষয়ে ভাবছে। এই আসনটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এতে বিএনপির বাইরে জামায়াতের প্রার্থী অকল্পনীয় বলে মনে করেন বিনেপি নেতারা।
সিলেট-২ আসনে জামায়াত এখনও সম্ভাব্য প্রার্থী ঠিক করেনি। তবে জেলার ৩ নম্বর আসনে (ফেঞ্চুগঞ্জ-দক্ষিণ সুরমা ও বালাগঞ্জ আংশিক) সংগঠনের দক্ষিণ জেলা শাখার সেক্রেটারি মাওলানা লোকমান আহমদের কথা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তিনি দক্ষিণ সুরমা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
সিলেট-৪ আসনে (জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ) জৈন্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও দলের নেতা জয়নাল আবেদীনকে ঠিক করেছে জামায়াত। বিএনপি থেকে মনোনয়ন-প্রত্যাশী ছাত্রদলের সাবেক নেতা মামুনুর রশীদও প্রচারণা চালাচ্ছেন।
কানাইঘাট উপজেলা ও জকিগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত জেলার ৫ আসনে মাওলানা ফরিদ উদ্দিনকেই চায় জামায়াত। এ ক্ষেত্রে বিকল্প প্রার্থী দেওয়ারও সম্ভাবনা কম বলে জানান বিএনপির একাধিক নেতা। সিলেট বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন বলেন, ‘এখানে জোটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, ২০০১ সালের নির্বাচনে মাওলানা ফরিদ উদ্দিন বিজয়ী হলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হন। মাওলানা ফরিদ জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও আঞ্চলিক পরিচালনা বিভাগের দায়িত্বশীল।
সিলেট ৬ নম্বর আসনটিতে প্রার্থী হতে চান জেলা শাখা দক্ষিণের আমির মাওলানা হাবিবুর রহমান। এ ব্যাপারে তিনি বলেন তাকে এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী চায় দল। এ জন্য কাজও করছেন তিনি। বিয়ানীবাজার উপজেলা ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী, জেলা সভাপতি আবদুল কাহের শামীম, মাওলানা আবদুর রশীদ সহ অনেকে।
জামায়াত ২০০১ সালে ৩১টি, এর মধ্যে জোটবদ্ধভাবে ৩০টি এবং এককভাবে একটিতে নির্বাচন করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩৯টি আসনে জোটগত সমর্থন পেলেও চারটি আসনে দলীয়ভাবে নির্বাচন করে। চারটি একক আসনের মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবারগঞ্জ-৩, ঝিনাইদহ ও মেহেরপুর। ২০০৮ সালে সিরাজগঞ্জ ও চট্টগ্রামের একটি আসনে প্রার্থী দেয় জামায়াত।
জামায়াতের বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত প্রায় কয়েকমাস আগেও ৫২টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি ছিল জামায়াতের। তবে শেষ দুই মাসে তৃণমূলের অভিমতের ভিত্তিতে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২-তে। এর মধ্যে শুধু বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের ৮টি আসনে প্রার্থিতা দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের ‘নির্বাচন কমিশন’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই এই সংখ্যাটি নির্ধারণ করা হয়েছে।
সিলেট জেলার ৫টি প্রার্থী পরিকল্পনা থাকলেও বিভাগটির মৌলভীবাজারে দু’টি আসনে ও সুনামগঞ্জ জেলার একটিতে দলীয় প্রার্থী দিতে চায় জামায়াত।
জানা গেছে, মৌলভীবাজার ২ আসনে (সদর ও রাজনগর) জেলার আমির আবদুল মান্নানকে বেছে নিয়েছে জামায়াত। এছাড়া মৌলভীবাজার-২ (বড়লেখা-জুড়ি) আসনে অ্যাডভোকেট মাওলানা আমিনুল ইসলাম চায় দলটি।
সুনামগঞ্জ-৫ আসনে (ছাতক-দোয়ারাবাজার) জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী মহানগরী কর্মপরিষদের সদস্য মাওলানা আবদুস সালাম। এলাকায় তিনি গণসংযোগ ও প্রচারণা চালাচ্ছেন বলে জামায়াতের একাধিক সূত্র জানায়।
সিলেট বিভাগের আসনে দলীয় প্রস্তুতি ও আগামী নির্বাচন সম্পর্কে জেলা দক্ষিণ শাখার আমির ও ইবনে সীনা হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান মাওলানা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে, নির্বাচন কিভাবে হবে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হবে, নাকি দলীয় সরকারের অধীনে? নির্বাচনে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হলে অবশ্যই অংশ নেবে জামায়াত। আসন বণ্টনের বিষয়টি কেন্দ্র ও জোট বলতে পারবে। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে, কোন আসনে, কে প্রার্থী হবেন।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট ১, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর আসনে জামায়াতের প্রার্থিতার প্রস্তুতি চলছে। এছাড়া সুনামগঞ্জের ২ টি আসনে ও মৌলভীবাজারের ১ টিতে প্রার্থীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।’
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র বলছে, জামায়াতের সঙ্গে আসন বণ্টনের আগে দু’টি বিষয় পরিষ্কার হতে হবে। একটি হচ্ছে, নির্বাচনের আগে হাইকোর্টে স্থগিত থাকা দলীয় নিবন্ধন ফিরে পায় কিনা, এ বিষয়টি। যদি নিবন্ধন ফিরে আসে, সেক্ষেত্রে এক ধরনের চিন্তা। দ্বিতীয়ত, নিবন্ধন না ফিরে পেলে জামায়াতের প্রার্থীদের দলীয় প্রতীক কী হবে, এ নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভাবনা। এক্ষেত্রে জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক না দেওয়ার পক্ষে বিএনপির একটি অংশ। অন্য অংশটির মতে, দলীয় প্রতীক মানে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ দিলে আসন সংখ্যা দাবি করবে কম। বিএনপির অন্য একটি পক্ষের যুক্তি, জামায়াত স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে দলের পক্ষে আসনসংখ্যা কম দেওয়া সহজ হবে।
জানতে চাইলে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কাহের শামীম বলেন, ‘নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কথা যেকোনও দল চাইলেই করতে পারে। আগামী নির্বাচন জোটের আসনবন্টন কিভাবে হবে, তা জোটের হাইকমান্ড ঠিক করবে। এখনই বলার সুযোগ নেই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট বিএনপির শীর্ষ এক নেতা বলেন, ‘জামায়াতের এমন চিন্তা এককথায় বিলাসিতা।’
এ বিষয়ে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট বিভাগীয়) ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন বলেন, ‘আসন নিয়ে জামায়াত যেকোনও চিন্তা বা প্রস্তুতিই নিতে পারে। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে সেটা যদি জোটভিত্তিক হয়, তাহলে আরও আলোচনা হবে। এখানে নিশ্চিত বলতে কিছু নেই। রাজনীতিতে সব সময়ই ফরওয়ার্ডিং থাকতে হয় না।’ রাজনৈতিক বাস্তবতা মাথায় রেখে এগুতে হয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।