স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও তাহিরপুরে শহীদ সিরাজের সমাধিস্থল অরক্ষিত

64

বাবরুল হাসান বাবলু তাহিরপুর থেকে :
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও জঙ্গলই রয়েছে শহীদ সিরাজুল ইসলামের সমাধিস্থল। বনের ঝোপ ঝারের আড়ালে মুছে যেতে বসেছে একজন শহীদ মুক্তযোদ্ধার শেষ স্মৃতি চিহ্নটুকু। শহীদ সিরাজুল ইসলামের নাম লোকমুখে শুনা গেলেও সমাধিস্থলের খোঁজ রাখেন না কেউ। তবে কি এখনো অরক্ষিতই থেকে যাবে তাহিরপুর উপজেলার যুদ্ধ-কালীন সাব সেক্টর টেকেরঘাট শহীদ সিরাজুল ইসলামের সমাধি স্থল ?
কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা থানার ছোট গ্রাম ছিলানী। সেখানেই জন্মেছিলেন দেশ প্রেমিক সিরাজুল ইসলাম। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি তুখোর ছাত্রনেতা। ৭ মার্চ বঙ্গুবন্ধুর ভাষণের পর দেশ মাতৃকার টানে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও নিজগ্রাম থেকে কয়েকজন যুবককে সাথে নিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ট্রেনিং নিতে তিনি চলে যান ভারত মেঘালয় রাজ্যের বালাট ক্যাম্পে। সেখান থেকে আসাম রাজ্যের ইকুয়ানে পাঠানো হয় গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে।
প্রশিক্ষণ শেষে মেজর মীর শওকত আলীর অধীনে যোগ দেন যুদ্ধ কালীন ৫নং সাবসেক্টর টেকেরঘাটে। তার দক্ষতার কারণে তিনি একটি কোম্পানীর সহকারী কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন সে কোম্পানীর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহুকুমার গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা বাজার দিয়েই পাক হানাদার বাহিনীর রসদ সিলেট পৌঁছানো হত। তাই এই নদী বন্দর কে মুক্ত করার জন্য মিত্র বাহিনীর মেজর বাট ও জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ৩৬ জন চৌকুস মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করা হয় একটি এডভান্স পার্টি। এ পার্টির নেতৃত্ব দেন সাহসী যোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম। ১৯৭১ সালের ৮ আগষ্ট এডভান্স পার্টি সূর্যাস্তের পরপরই শুধু মাত্র ত্রি-নট থ্রি রাইফেল আর গ্রেনেড কমান্ডার সিরাজের নেতৃত্বে ট্যাকেরঘাট সাব সেক্টর হতে ২৫ মাইল দক্ষিণে সাচনা বাজার পৌঁছে পাক হানাদার বাহিনীর সুরক্ষিত ব্যাংকারে গেরিলা আক্রমণ করেন। অতর্কিত হামলায় ব্যাংকারে অবস্থানরত পাক বাহিনীদের মৃত্যু হয় এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম আনন্দে লাফিয়ে উঠে জয়বাংলা শ্লোগান দিতে থাকেন এমন সময় পাক বাহিনীর একটি বুলেট এসে তার চোখে বিদ্ধ হলে সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং কিছুক্ষণ পরই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর শহীদ সিরাজুল ইসলামকে মৃত দেহ টাকেরঘাট সাবসেক্টরে নিয়ে আসা হয় এবং পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় টেকেরঘাট সাব সেক্টরে সমাহিত করা হয়। তার অসামান্য অবদানের জন্য শহীদ সিরাজুল ইসলামকে সরকার বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করেন।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি ধরে রাখতে পারিনি আমরা কিন্তু শহীদ সিরাজতো মৃত্যুকে পাথেয় হিসেবে নিয়ে স্বাধীনতার জন্য দেশের জন্য যুদ্ধে বেড়িয়েছেন তাইতো তিনি তার বাবাকে লিখা শেষ চিটিতে লিখেছেন…
‘বাবা দোয়া করবেন নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়, মায়ের প্রতি খেয়াল রাখবেন, আমার অনুপস্থিতিতে মা’কে কষ্ট দিবেন না বাবা। মৃত্যুর মুখে থেকে যুদ্ধে করছি কখন জানি মৃত্যু হয় জানি না। মৃত্যুর জন্য তবে সব সময়ই প্রস্তুত রয়েছি। কারণ দেশ স্বাধীন না হলে জীবনের কোন মূল্যই থাকবে না। তাই যুদ্ধকে পাথেও হিসাবে নিলাম আমার রক্তের বিনিময়ে যদি দেশ স্বাধীন হয় তখন দেখবেন লাখ লাখ সন্তানেরা এক পুত্র হারা বাবাকে ডাকবে। সে ডাকে অপেক্ষাই থাকবেন বাবা। আমার কিছু হয়ে গেলে আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মতই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। জানিনা তার বাবা মা তার শেষ চিটি পড়তে পেরেছিলেন কি-না শুধু এইটুকু জানি আজো তার দু’বোন ভাইয়ের শেষ চিটিকে বুকে চেপে অশ্র“ জড়ায়।
ট্যাকেরঘাট সাব সেক্টরে শহীদ সিরাজের সহযোদ্ধা রৌজ আলীর কাছে এখনো সংরক্ষিত আছে সিরাজের লেখা বাবকে শেষ চিঠিটা।
সাবেক তাহিরপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শহীদ সিরাজের চিঠি সংরক্ষণ করেছেন ঠিকই কিন্তু স্বাধীনতার পর এত বছর ধরে বিভিন্ন লোকের দ্বারে দ্বারে হেঁটেও কি পেরেছেন একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু সংরক্ষণ করতে।