মা জননী

48

মোঃ ফিরোজ হোসেন

জানো মা ! তোমার কথা মনে হলে
কেমন যেন শিশু হয়ে যাই আজও
যদিও আমি আয়ুরেখা ধরে হেঁটেছি অনেকটা পথ
এখনও যেন স্বপ্নের মতো
গলা জড়িয়ে তোমার বুকে লেপটে থাকি
শিশুর মতো এখনও জমতে থাকে শত শত আবদার
বায়নাগুলো তোমাকে জানাবো বলে মুখিয়ে থাকি সদাই
ছোট্ট বেলার হারিয়ে যাওয়া ক্ষণগুলি
মনের গভীরে দোলা দেয় বারবার
কপোল গড়ানো চোখের জল ঝরে পড়ে জমিনে ।

মনে পড়ে কী মা !
মিশু, করিম কিংবা বাসুদের বাবারা যখন
হরেক রকম খাবার হাতে বাড়ি ফিরতো
এক দৌড়ে চলে আসতাম তোমার কাছে
গলা জড়িয়ে ধরে বলতাম
মা ! আমার বাবা কোথায় ?
বাবা কেন আমাদের কাছে আসেনা ?
নির্বাক হতে ক্ষণকাল
আর্দ্র চোখে আঁচলে মুখ ঢাকতে
মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে
স্বাধীনতার লড়াইয়ের সময়
যেখানে ব্যবসা করত তোমার বাবা
সেখান থেকে একদিন দুষ্টু লোকেরা
একটা লোককে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল
তাকে রক্ষা করতে রাত হয়ে যায় তোমার বাবার
সেই রাতে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর পৃষ্ঠদেশে
বাইশটি কোপ দিয়েছিল খুনীরা
রাগ করে তাই
আল্লাহর কাছে চিরতরে চলে গেলেন
সেই থেকে তুমি শুধু আমাদের মা নও
বাবাও হয়ে উঠলে, হয়ে উঠলে একমাত্র অবলম্বন
বড় হয়ে জেনেছি
বাবার খুনীরা ছিল বিচারবোধহীন “নকসাল” ।

তুমি সেই জননী, সংগ্রামী মা !
মহাযোদ্ধার মতো শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে
ছায়ার মতো আগলে রাখতে সর্বক্ষণ
তিলে তিলে গড়ে তুললে আমাদের
মনে আছে মা !
খাবার সময় হলে প্রায়ই দুধ-ভাতের বায়না ধরতাম
আর কাঁদতে থাকতাম অবিরত
ভারী অসহায় হয়ে পড়তে অসামর্থ্যরে কারণে
শেষেমেশ পানি-লবণ দিয়ে মেখে দিতে ভাত
খেতে খেতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তাম ।

আমরা ভাই-বোনেরা ছিলাম বেশ ঠাণ্ডা-প্রকৃতির
ভারী চঞ্চল ছিল বড়ভাইটি কেবল
বড়ভাইকে পিটুনি দেয়ার কথা মনে আছে মা !
বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বেশ রাত করেই
একবার বাড়ি ফিরেছিলাম আমি ও বড়ভাই
তোমার সে কী রাগ, শাসন !
কেন সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরা হয়নি ?
কেন সময় মত পড়তে বসা হয়নি ?
ভয় পেয়ে বড়ভাই পালালো, সারারাত বাড়ি ফেরেনি
মাঝে মাঝে এমনিকরে ঘর-পালাতো বড়ভাই
কী নিদারুণ অস্থির ছিলে সে রাতে !
এখানে সেখানে রাতভর খোঁজাখুঁজি
ভোরবেলা ঘুমন্ত আবিষ্কার করলে বড়ভাইকে
প্রতিবেশীর ক্ষেত পাহারা দেবার টঙঘরে
ভয়ঙ্কর অগ্নিমূর্তি দেখেছিলাম সেদিন তোমার
শশা-মাচার খুঁটি দিয়ে কী পিটুনিটাই দিলে
সেই থেকে বড়ভাই
ছেড়ে দিল ঘর-পালানোর বদঅভ্যাস ।

মা ! একবার দেখে যাও
স্মৃতির আয়নায় ছবির মতো ভেসে উঠছে
কৈশোরে মাছ ছাড়া ভাত খেতে কষ্ট হতো
দুবেলা ডাল-ভাত জোটানো যেখানে কষ্টকর
সেখানে মাছের জোগাড় !
তোমার অসহায়ত্ব ভারী প্রকট হয়ে উঠতো
বৃষ্টি দেখে দুচোখে সে কী খুশির ঝিলিক !
বৃষ্টির জল আটকে রাখতাম
তারপর নালা কেটে জোড়াপুকুরে ছেড়ে দিতাম
জলের স্রোত ধরে নালা বেয়ে নানা পদের মাছ
যেমনঃ পুঁটি, কৈ, শিং, টেংরা উঠে আসতো
সেই মাছগুলো খুব সুন্দরভাবে রান্না করে দিতে
ভীষণ মজা করে খেতাম আমরা
জানো মা !
তোমার হাতের রান্না খেতে এখনও খুব ইচ্ছা জাগে ।

একটু একটু বড় হতে থাকলাম
মা, নির্ভার হবার সময় হলো বুঝি
কিন্তু হায় ! দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ে না
আল্লাহর ইচ্ছা বুঝি ভিন্ন ?
হঠাৎ তুমি চলে গেলে না ফেরার দেশে
যারা বড় যোদ্ধা হয়
তাদের বুঝি বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই ?
কর্তব্য শেষে তাদের বুঝি চিরবিদায় নিতে হয় ?
মা জননী আমার !
এখনও আমি শিশুর মতো খুবই অসহায়
তোমার আঁচলের ছায়ায়
আজও আশ্রয় খুঁজে ফিরি নিয়ত।