শুধু সাক্ষর নয়, সুশিক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে হবে

60

আফতাব চৌধুরী

আমাদের দেশে ৬ বছরের ঊর্ধ্বে শিশুকে শিক্ষাদানের নীতি সরকারীভাবে স্বীকৃত। এ নীতির বাস্তবায়নে সরকার দৃঢ় সংকল্প। ব্যয়ও করছেন কোটি কোটি টাকা। এত সবের পর প্রশ্ন একটাই শিক্ষার অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে? স্বীকার করতে হবে সাক্ষরতার হার বেড়েছে শুধু নাম লেখা পর্যন্ত। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি বেড়েছে স্কুলের সংখ্যা ও শিক্ষকদের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে কি?
শিক্ষক সমাজের মেরুদণ্ড, ছাত্ররা দেশের ভবিষ্যৎ। এ পঙক্তিগুলো পৃথিবীর প্রত্যেক সাক্ষরজ্ঞান থাকা ব্যক্তিমাত্রেরই জানা। কিন্তু থাকলে কী হবে? আজকের দিনে একজন শিক্ষক তাঁর দায়িত্ব কতটুকু পালন করেন। আর ছাত্ররাই বা কতটুকু দায়িত্ব নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকরা কী কর্তব্য পালন করছেন তা-ও দেখতে হবে।
বাংলাদেশ যেহেতু গ্রামকেন্দ্রিক আর গ্রামে বসবাস করেন বেশীরভাগ নাগরিক, তাই গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার ছবিটা দেখে নেওয়া প্রয়োজন। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, গত কয়েক দিনে প্রায় ২৫ টি স্কুলের খবর নিয়ে অবগত হয়েছি তাতে অবাক না হয়ে উপায় নেই। বড় একটা অংশের স্কুলগুলো  কোনও না কোনভাবে সমস্যায় জর্জরিত। কোথাও স্কুল আছে পড়া-লেখার পরিবেশ নেই। কোথাও স্কুল আছে, কিন্তু সেখানে গরু-ছাগলের আস্তানা গাছপালা নেই, ফুল ও ফলের বাগানও নেই । আবার কোথাও স্কুল থাকলেও শিক্ষকের অভাব। তা হলে লাভটা কী হচ্ছে? সরকার এত টাকা ব্যয় করে সত্যিই কি সবাইকে শিক্ষা প্রদান করতে পারছে? উত্তর- না।
পরিসংখ্যান বাড়িয়ে লাভ কী? শুধু নাম লেখা জানা ব্যক্তিদের গণনায় এনে যদি আমরা শিক্ষিতের হার বিবেচনা করি, তবে কি আমাদের হিসেবে এগিয়ে যাবে। কখনও না। কোনও একদিন ছিল যখন শিক্ষাকে ব্যবসা থেকে দূরে রাখা হত। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা এ দেশের সব থেকে বড় ব্যবসা।
সরকারের লুকোচুরি আর ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক ধান্দা নষ্ট করছে লক্ষ লক্ষ সন্তানের ভবিষ্যৎ। আগামী প্রজন্মের হাঁটু ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। সমাজে ধনী-দরিদ্রের ফারাক প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শিক্ষাজগতে শুরু হয়েছে দরিদ্র ও অভিজাত ছাত্রের অসম প্রতিযোগীতা।
বিত্তশালীরা অঢেল টাকা ব্যয় করে সন্তানকে নামী-দামি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার জন্য পাঠাচ্ছেন, যদিও তাদের সংখ্যা খুব কম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের এখানেই। এই কম সংখ্যকই আমাদের দেশটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। গ্রামের কৃষক যতদূর মেধাবী ছেলে হোক, সে যদি ডাক্তার হওয়ার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে তার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠে না। মধ্য ও উচ্চ শিক্ষিতরা বলেন, সরকার ঋণের ব্যবস্থা করেছে দরিদ্র মেধামী ছাত্রদের জন্য। কিন্তু তাতো বাস্তবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আজ যখন কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে যায় তখন তাকে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। বাধ্য হয়ে তাকে দালাল ধরতে হয়। দালালরা নিয়ে নেয় অর্ধেক টাকা। স্বচক্ষে না দেখে বর্তমান যুগে কেউ একথা বিশ্বাস করতে চায় না। বাস্তবকে কখনও ঢেকে রাখা যায় না বলে প্রবাদ আছে। যদিও আজ এ প্রবাদের মান অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। বর্তমান অভিজাতরা বাস্তবকে ঢেকে রাখার কৌশল খুব ভালভাবেই রপ্ত করে নিয়েছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা আজ শিক্ষার বদলে দুর্নীতি বেশি শিখছে। বাড়িতেও তাই। অধিকতর অভিভাবক সন্তানদের পরোপকারী হওয়ার কোনও উপদেশ দেন না, দেন শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাধারা, আদর্শ গড়ে তোলার। ফলস্বরূপ তারা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে, যৌথ পরিবার ভাঙছে, মা-বাবাকে বৃদ্ধাবাসে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
এ সবের পেছনে সর্বাধিক দায়ী আমাদের বর্তমান ত্র“টিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষিতের হার বাড়াতে যত মনোযোগী ততটা যদি প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ গড়তে মনোযোগী হত, তবে সমাজ থেকে মূল্যবোধ আজ এতটা হারিয়ে যেত না।
মূল্যবোধহীন শিক্ষা জন্ম দিচ্ছে দুর্নীতির। আর এতে সমাজের প্রতিটি স্তরে এত গভীরভাবে দুর্নীতির শেকড় প্রোথিত হচ্ছে যে আমরা আজ যে কোনও কাজকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখি। দুর্নীতিহীনতা দেখলে অবাক হই। এ সব চিন্তাধারার জন্ম দেওয়ার জন্য আমরা কাকে দায়ী করতে পারি? আমাদের আজ এই অবক্ষয় থেকে কে মুক্তি দিতে পারে? অবশ্যই শিক্ষা। তবে যান্ত্রিক ব্যবসায়িক শিক্ষা নয়, সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা। আর মূল্যবোধ সৃষ্টির শিক্ষা হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা। সে শিক্ষাতো সে ভাবে দেয়া হচ্ছেনা আর এর জন্য মূল্যবোধও সৃষ্টি হচ্ছেনা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। একদিন ছিল যখন ছাত্ররা স্কুল থেকে এসে কোনও লেখকের বই নিয়ে পড়তে বসত অবসর বিনোদনের জন্য, নতুবা সহপাঠীদের সঙ্গে খেলতে যেত। আজ এ সব হারিয়ে গেছে। অনুর্ধ্ব পনেরো বছরের বালক-বালিকার হাতে পৌছে গেছে মুঠোফোন। সময় কাটানোর জন্য মোবাইল ফোনে গান শোনা, ফেসবুকে দীর্ঘক্ষণ বসে আড্ডা মারতেই ভালবাসে তারা।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা তা হলে যাচ্ছি কোথায়? ভাবতেও অবাক লাগে আমরা সামাজিক দুনিয়াকে পেছনে ঠেলে দিয়ে এক নতুন দিশায় হাঁটছি। এখানে কি আমরা একা হয়ে যাচ্ছি না? হ্যাঁ, আমরা এককেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। আমরা আজ সম্পূর্ণ একা। আমাদের সামাজিকতায় এখন আর নৈতিকতার প্রশ্রয় নেই। ভোগ্যপণ্যের প্রতি দিন দিন লালসা বাড়ছে। নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হচ্ছে গ্রাম্য দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা। ছেলেরা স্কুল ছেড়ে হাজার মাইল দূরে পাড়ি দিচ্ছে পেট পালার তাগিদে। প্রয়োজনীয় শিক্ষা না থাকায় ওখানেও তারা স্বল্প বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। পরিশ্রম অধিক, তাই কাজের পর অবসর বিনোদনস্বরূপ নেশা করে। মদ, ড্রাগস, ধূমপান প্রভৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। পুরো বছর কাজ করে যে টাকা উপার্জন করে তাতে বাড়ি আসার ভাড়াও জোগাড় হচ্ছে না। সৃষ্টি হচ্ছে ‘জেনারেশন গ্যাপ’-এর।
নতুন গ্রাম্য প্রজন্ম শুধু সরকারি মাধ্যমের স্কুলে সপ্তম, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে চলে যাচ্ছে বিদেশে। সরকারি পরিসংখ্যানে তারা শিক্ষিত, কিন্তু প্রকৃতরূপে তারা কতটুকু শিক্ষিত তা বিচারের ভার পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম। আগেই বলেছি আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু শিক্ষিতের হার বাড়ছে না। এর জন্য অবশ্যই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন জরুরি। শুধু শুধু সাক্ষর বানানোর জন্য গ্রাম্য দরিদ্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা অনুচিত। দুর্নীতি দূর করতে হবে শিক্ষা বিভাগ থেকে। গ্রামের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীকে দেখা যায় নিজের বাবার নাম লিখতে পারে না। উপযুক্ত শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষাদানের পাশাপাশি ছাত্রানুপাতে শিক্ষক নিয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একশ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য একজন শিক্ষক হলে শিক্ষাদান সাক্ষরতায়ই সীমাবদ্ধ থাকবে।
পরিবর্তনশীল সমাজের জন্য সুফল বয়ে আনে, তবে তা যদি সঠিক হয় তখন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো হত, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে না উপযুক্ত রূপে। শিক্ষার অধিকার আইন সম্পূর্ণ সঠিক। কিন্তু সাক্ষরতার হার নয়। বাড়াতে হবে প্রকৃত শিক্ষিতের হার। নতুবা আমাদের বর্তমান যে শৈক্ষিক অবস্থান রয়েছে তা আরও রসাতলে যাবে। দেশের একটি বড় অংশের মানুষ দিনাতিপাত করে মাত্র সতেরো টাকায়। তাদের জন্য প্রথম গুরুত্ব পেট পোষা, শিক্ষা দীক্ষা নয়। ওই অংশকে ছেড়ে দিলে শহরগুলো ও গ্রামীণ বাংলাদেশের প্রায় ষাট শতাংশ মানুষের প্রথম তাগিদ ভাতের ব্যবস্থা, তাদের কাছে শিক্ষার অবস্থান দ্বিতীয়। যেহেতু তারা রুটি-রুজির তল্ল¬াশিতে ব্যস্ত থাকে, তাই শিক্ষিত হয়ে ওঠা তাদের কাছে আকাশকুসুম কল্পনা। সরকার তাদের সাক্ষর করেই দায়িত্ব শেষ করে দিচ্ছে। আর এই শিক্ষাবিহীন সাক্ষরতা সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যার জন্য অবশ্যই দায়ী তারা নিজে নয়, সরকার।
উপসংহারে বলব, সরকার শুধু সাক্ষরতায় নজর দিলে মঙ্গলের বদলে অমঙ্গলই হবে। সাক্ষরতার পাশাপাশি প্রকৃত শিক্ষিতের হার বাড়ানোর উপর নজর দেওয়াই হতে হবে প্রথম এবং প্রধান কাজ। নাকি ভুল বললাম?