স্মৃতির ঝরণায় সিক্ত দিনগুলো

131

মোঃ সুরুজ মিয়া
২১-০৬-১৭ থেকে ছিল আমার ছুটি। ছুটির দুদিন আগে টিকিট কেটেছিলাম। মাকে ছাড়া ঈদ করতে আমার ভালো লাগে না। তবুও মায়ের অনুমতিক্রমে বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুুত হলাম। আমার খুব কাছের বন্ধু আব্দুল হাফিজ (সম্পর্কে মামা) ও আব্দুল আহাদ ওরা আমাকে বাড়িতে যাওয়ার জন্য এবং এক সাথে ঈদ করার জন্য আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছিল। সর্বোপরি আমারও মনের টান ছিল বাড়িতে যাওয়ার জন্য। যাই হোক রওয়ানা দিলাম। আমার সস্ত্রীক ভ্রমণের পুরোনো যন্ত্রণা হচ্ছে বাসে উঠলেই আমার স্ত্রীর বমি হয়। এবং বাসে থাকাকালীন সময়ে সে এদিক ওদিক কোন কিছু দেখতে চায় না। আমার পাশে ব্যাগে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে সে যায়। এ জন্য ওকে নিয়ে বাস যাত্রা আমার হুয়াংহু নদী হয়ে যায়। দিন শেষে আমার উপজেলা মদনে পৌছলাম প্রায় সাড়ে ছয়টা। কিছু বি¯ু‹ট কিছু পান-সুপারী কিনলাম যদিও আমরা পান-সুপারী খাইনা। আমি আমার বাড়িতে যাওয়ার  আগে শ্বশুর বাড়িতে আগে যাই। কারণ আমার স্ত্রীর ইচ্ছে পূরণের লক্ষ্যে গ্রামে শ্বশুর বাড়ির লোকজন আমি গেলে অনেক প্রতিবেশীরা আসেন এবং বলেন যে জামাই কি পান-সুপারী এনেছে? তাই আমার পান-সুপারি কেনা। এরপর আমি রিক্সায় করে আমার মামার বাড়ি ধূবাওয়ালা যাই। ধূবাওয়ালা থেকে নৌকা যোগে গেলাম শ্বশুর বাড়ি কৃষ্ণপুর। পরের দিন স্ত্রীকে রেখে চলে গেলাম আমার বাড়ি বাগজানে। বাড়িতে যাওয়ার পথে যত পরিচিত মুখ সকলের সাথে কুশল বিনিময় করতে করতে মেইন রাস্তা হতে বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে পনের মিনিটের রাস্তা হয়ে গেল পৌনে এক ঘন্টা। এর  পরেও কুশল বিনিময়ের কিছুই হলো না। কেননা এরা ত ছিল পথে পাওয়া লোক। বাকি তো রয়ে গেল সবাই। পথে যেতে পেয়ে ছিলাম সফর উদ্দিন, আশরাফুল, কায়কোবাদ, পিকুল, ফারুক, ও আরও অনেক কে। গ্রামের বাড়িতে যথেষ্ট উন্নতির জোয়ার প্রত্যক্ষ করলাম। বাড়িতে বাড়িতে আধা পাকা বড় বড় টিনের ও টিনসেডের ঘর। ঘরে ঘরে ছাত্র, চাকুরীজীবী, কর্মজীবী। বেকার নেই বললেই চলে। আমার বাড়িতে রোজায় প্রথম ইফতারের দাওয়াত ছিল আমার চাচাত ছোট ভাই আব্দুল আহাদের বাড়ি। আঃ আহাদের ছোট বোন রান্না-বান্না করেছিল, যা ছিল খুবই সুস্বাদু। কিছু নতুন আইটেম করে ছিল সে যা প্রশংসনীয়। রান্নায় তার দক্ষতা আছে। সে এস এস সি পরীক্ষার্থী। তার রেজাল্ট সব সময় ভাল হয়। আমার মায়ের মত চাচীর অর্থাৎ আঃ আহাদের মায়ের শরীর সব সময় এই সমস্যা ওই সমস্যা থাকে। যা হোক ঈদের আগের আমি আঃ হাফিজ ও আঃ আহাদকে বললাম খুব সকাল সকাল গোসল করে ঈদগায় যাব এবং ঈদগায় প্রথম কাতারে নামাজ পড়ব। ঈদের দিন ভোরে আমি আঃ হাফিজ  ও মঞ্জু মামা কে নিয়ে গেলাম লড়িভাঙ্গা ব্রীজের কাছে। ওখানে পরিষ্কার ও হাওরের স্বচ্ছ স্রোতের পানিতে গোসল করলাম। খুবই উপভোগ্য ছিল সেই গোসল করা। গোসল শেষে পোশাক পরিবর্তন করে জায়নামাজ নিয়ে গেলাম ঈদগায় কিন্তু প্রথম কাতার পেলাম না। যা হোক ঈদগায় বসলাম কিন্তু পরিচিতরা কথা বলতে চায়, এখন ইমামের বয়ান শুনব নাকি অন্যদের সাথে কথা বলবো তাই যথা সম্ভব এদেরকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করলাম। ঈদের নামাজের আধঘন্টা আগে বেশ একটা মূষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টির সময় আমরা গা বাঁচানোর জন্য অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলাম। আবার নামাজের পনের মিনিটি আগে বৃষ্টি শেষ হয়ে গিয়ে ছিল। যার কারণে যথা সময় সুষ্ঠুভাবে নামাজ পড়তে পেরেছিলাম। ঈদের দিন প্রত্যেক আত্মীয়ের ঘরে আয়োজন করেছিল সেমাই। যার ঘরেই যাওয়া হয় সেমাই খেতে দেয়া হয়। জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়। একজনে কত বার খাব? না খেলেও গোস্বা হয়। পড়লাম বিপদে তাই শুরু করলাম হাফ পিরিচ করে সেমাই খাওয়া। একেক বেলা খাই দু’তিন ঘরে। অতি ঘনিষ্ঠ জনদের বাড়িতে ভাত মাংস ত আছেই। এভাবেও ঈদের ছুটিতে আত্মীয়ের বাড়িতে খাওয়া শেষ করতে পারিনি। অনেকেই আমার প্রতি রাগ করে আছেন এখনও। ঈদের দিন বিকেল বেলা আমি রওয়ানা দিলাম আমার শ্বশুর বাড়ির দিকে। অটো বাইকে উঠলাম। যেহেতু নৌকা করে যাওয়া লাগে, শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার আগে ফোন করলাম যে, আমি আসছি। আমার জন্য নিয়ে আসা নৌকায় উঠার আগে দেখলাম নৌকায় একটি মেয়ে ছাতা মাথায় বসে আছে। মেয়েটির মুখের অর্ধাংশ দেখেছিলাম। এতে বুঝলাম মেয়েটি সুন্দরী হতে পারে এবং মেয়েটি ছিল লম্বা। মেয়েটি ছাতা দিয়ে আড়াল হয়ে বসল। মেয়েটি আমার শ্বশুরবাড়ির। জিজ্ঞেস করে জানলাম, সে কলেজে ১ম বর্ষে পড়ে। মনে মনে ভাবলাম বন্ধু ও মামা হাফিজ বলেছিল ওনার জন্য পাত্রী দেখতে। এই মেয়েটিকে দেখার জন্য আমি হাফিজ মামাকে বললাম। হাফিজ মামা বললেন পাত্রীকে আমি আগে দেখি, যদি পছন্দ হয় পরে মাকে বলবো। তবে আমার যা আকাক্সক্ষা, মেয়েটি শিক্ষিত ও সুন্দরী হতে হবে। বিষয়টি আমার শ্বশুরকে আমি বললাম যে, আমার কাছে একজন ভালো পাত্র আছে। ঐ বাড়ির মেয়েটিকে বিবাহ দিবে কিনা আমরা জানতে চাই। আমার শ্বশুর খবর নিলেন এবং জানতে পারলেন যে, পাত্রী পক্ষ কমপক্ষে এইচ.এস.সি শেষ করার পর মেয়েকে বিবাহ দিবে। আমি হাফিজ মামাকে বিষয়টি বললাম, তিনি বললেন সমস্যা নাই। আপাতত আমরা দেখতে চাই। মেয়ে পক্ষ বললো ঠিক আছে দেখতে পার, আমরাও পাত্র দেখতে চাই। ২৮-০৬-২০১৭ তারিখ আমরা পাত্রী দেখবো বলে খবর দিলাম। পাত্রী পক্ষ বললেন আসো। আমরা গেলাম প্রায় ১০টায় ওদের বাড়ি। সাথে নিলাম কিছু জুস, বিস্কুট, চিপ্স ইত্যাদি। অনেকক্ষণ আলাপ আলোচনা হলো। জানতে পারলাম এই পরিবারের ছেলে মেয়েরা সবাই শিক্ষিত ও মেধাবী। অনেক কিছু খাওয়ালেন ওনারা। কিন্তু পাত্রীতো দেখানো হচ্ছে না। আমরা বললাম আমাদের তাড়া আছে। এরপর মেয়েটিকে সামনে নিয়ে এলেন, মেয়েটি ছিল শ্যাম সুন্দরী ও লাবণ্যময়ী। পাত্রীর সাথে কথা হলো হাফিজ মামার। পাত্রীর বাবা-মা তো পাত্র দেখলেনই। হাফিজ মামাও অপছন্দ হবার পাত্র নন। স্মার্ট, লম্বা ও শিক্ষিত ছেলে এবং সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী। পাত্রী দেখার পর পাত্রীকে কিছু টাকা সেলামী দেওয়ার রীতি আমাদের সমাজে আছে। হাফিজ মামা আমাকে বললেনÑ টাকাটা কিভাবে দিব? সরাসরি তার হাতে দিব নাকি অন্য কেউ আমার থেকে দিবে। আমি বললামÑ এ অভিজ্ঞতা আমার নেই। আমি আমার শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন- সরাসরি দেওয়া ভালো। এরপর হাফিজ মামা এক হাজার টাকা দিলেন আর বললেন বড় ভাই হিসেবে দিলাম কিছু খেয়ে নিও। এরপর আমার সম্ভাব্য মামী হাসলেন এবং লাজুক মনে টাকাটা নিতে চাইছিলেন না, পরে নিলেন। আমাদের তাড়া থাকায় আমরা সালাম দিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় হাফিজ মামার সম্ভাব্য শ্বাশুড়ী হাফিজ মামাকে কি যেন দিতে চাইলেন। পরে দেখা গেল জোর করে তিনি কিছু টাকা দিলেন। নৌকা যোগে ওদের বাড়ি থেকে অনেক দূর আসার পর মামাকে বললামÑ দেখ তো কত টাকা দিল? গুণে এক হাজার একশত টাকা পাওয়া গেল। হাফিজ মামা তখন হেসে হেসে বললোÑ পাত্রী দেখে আরও একশত টাকা লাভ হলো। নৌকা দিয়ে ওদের আমি জলভাগ পার করে আমি থেকে গেলাম আমার শ্বশুর বাড়ী। আব্দুল আহাদ ও হাফিজ মামা চলে গেল বাড়িতে। পরের দিন আমি ফোন করে হাফিজ মামাকে পাইনি। আব্দুল আহাদকে ফোন দিলাম। বললাম মামার কি পাত্রী পছন্দ হলো? সে বললোÑ হ্যাঁ-না কিছুই তো বলেন নি তিনি। উল্টো সে আমাকে প্রশ্ন করলোÑ পাত্রী পক্ষের খবর কি? আমি বললাম জানতে পারিনি। একে একে সবাই চলে যাই যার যার কর্মস্থলে। মোট কথা সস্ত্রীক বাস ভ্রমণ বাদে সবখানে খুব মজা করলাম এবারের ঈদে। বিশেষ করে দুটি নতুন রীতি প্রচলিত হচ্ছে মনে হয় আমাদের এলাকায়। যেমন প্রথমতÑ ঈদ উপলক্ষে বিবাহের ধুম পড়তে দেখা যায়। এটা সম্ভবত হতে পারে এ জন্য যে এসময় বিভিন্ন জেলায় কর্মরত দেশের লোকজন বাড়িতে আসে। ফলে আত্মীয় স্বজনদের এ সময় পাওয়া যায়। যেমন এবারের ঈদে ৩০-০৬-২০১৭ তারিখ আমার মামাতো ভাই আয়াতউল্লাহও বিবাহ করেছে এবং সে বিবাহ হয়েছে যৌতুকবিহীন। একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত সে স্থাপন করেছে। সে তার বাবাকে মুখ বরাবর বলেছে যে যৌতুক নিতে চাইলে আমি বিয়েই করবো না। আমি তার দুনিয়া ও আখিরাতের মঙ্গল কামনা করি তার সৎ দৃঢ় প্রত্যয় কুরআনের পক্ষে পক্ষ অবলম্বনের জন্য। দ্বিতীয়ত হচ্ছেÑ ঈদ প্রমোদের জন্য লোকজন নৌকা ভ্রমণ ও অটোবাইক ভাড়া করে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো। তাই গেল ঈদে আমি প্রচন্ড আনন্দ ও স্মৃতির ঝরণায় সিক্ত হয়েছিলাম।
লেখক : নিবন্ধকার, বন্ধু নং-১২৯৮।