সিলেটের চার উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি

69

স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেটের প্রধান দুটি নদী-সুরমা ও কুশিয়ারার পানি এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যে কারণে 19437668_812006572300327_4142675491319885237_n copyবিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টায় কানাইঘাটে সুরমা নদী বিপদ সীমার ৬৯ সেন্টিমিটার, আমলসিদে কুশিয়ারা বিপদসীমার ১০৫ সেন্টিমিটার, শেওলায় কুশিয়ারা বিপদসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার এবং শেরপুরে কুশিয়ারা বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, পানি কিছুটা কমলেও এখনো দুই নদীর পানি বিপদসীমার নিচে নেমে আসেনি। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গনও দেখা দিয়েছে বলে জানান তিনি।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম চৌধুরী গতকাল শুক্রবার শরীফগঞ্জ ও উত্তর বাদেপাশা ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত ৪০ জন লোকের মধ্যে নগদ অর্থ বিতরণ করেন।
এছাড়া, বিয়ানীবাজারে ইউএনও মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, ফেঞ্চুগঞ্জের ইউএনও হুরে জান্নাত, গোলাপগঞ্জের ইউএনও মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন এবং জকিগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত ইউএনও মো: মিজানুর রহমান সংশ্লি¬ষ্টরা বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
গোলাপগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন : চৈত্রের অকাল বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই ফের গোলাপগঞ্জে বন্যার পানিতে ভয়াবহ দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এবং অতি বর্ষণের ফলে উপজেলার হাওর এলাকাসহ ৬টি ইউনিয়নের কয়েক শতাধিক ঘরবাড়ী পানিতে নিমজ্জিত। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বন্যা আক্রান্ত এলাকাগুলোতে ঈদের আনন্দের বদলে বইছে বিষাদের ছায়া। হাওর এলাকার বাড়ীঘরগুলো এখন একিবারে পানিতে নিমজ্জিত। পানিতে ডুবে যাওয়া ঘর বাড়ির লোকদের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। এ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টি ইউনিয়ন হাওর এলাকায়। গতকাল শুক্রবার বন্যা কবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক ও উপজেলার নির্বাহী অফিসারসহ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা। বিভিন্ন এলাকার কাচা আধাপাকা রাস্তাগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। গত কয়েকদিন থেকে বন্যার পানি অব্যাহত ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় হাকালুকি হাওর পারের প্রায় ঘরবাড়ীই পানিতে তলিয়ে গেছে। এর ফলে গবাদি পশু ও শিশুদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে প্রতিটি পরিবার। গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার শরীফঞ্জ ও বাদেপাশা ইউপির প্রায় প্রতিটি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে প্রকট আকার। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, স্কুল, মসজিদ মাদ্রাসাসহ অসংখ্য ঘরবাড়ী। সাপ বিচ্ছুসহ বিভিন্ন আতঙ্কে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাবাসী। ছোট ছোট শিশু কিশোরদের নিয়ে মা বাবা রয়েছেন আতঙ্কে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে ছুটে যাচ্ছে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে। অনেকে শুকনো খাবার খেয়ে দিনযাপন করছেন। বন্যা আক্রান্ত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সংকট দেখা দিয়েছে। শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের খাটকাই গ্রামের হাছনা বেগম জানান বসত ঘরে পানি ঢুকে যাওযায় আমার ছোট সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য আত্মিয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া ভাদেশ্বর, বুধবারীবাজার, আমুড়া ও ঢাকাদক্ষিণ ইউপির অনেক গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এ এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ বন্যার কারনে এখন বেকার হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এতে করে দিনদিন হুমকির মুখে পড়ছে বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ। পশ্চিম আমুড়া ইউপির চেয়ারম্যান রুহেল আহমদ জানান, বন্যা দুর্গত হাওর এলাকার লোকদের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এখনো কোন প্রকার সহায়তা পাওয়া যায়নি। তবে কর্তৃপক্ষ আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছেন ভাদেশ্বর ইউপির চেয়ারম্যান মোঃ জিলাল আহমদ জানান আমার এলাকায় এখনো কোন প্রকার সহায়তা দেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আলতাফ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, গতকাল শুক্রবার জেলা প্রশাসক মহোদয় বাদেপাশা ও শরিফগঞ্জ ইউনিয়ন পরিদর্শন করে এসেছেন এবং উত্তর বাদেপাশা ইউনিয়নে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে বেশ কয়েকজনকে চাল ও নগদ ৫শ টাকা করে বিতরণ করা হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য ১৮টন চাল গোলাপগঞ্জে পৌছেছে। কেউই বাদ পড়বেন না।
এদিকে বিয়ানীবাজার থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন : বিয়ানীবাজার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে আরো। থেমে থেমে বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢলে পানি বাড়ছে, প্লাবিত হচ্ছে আরো নিম্নাঞ্চল, নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। তবে বিয়ানীবাজারে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হলেও এখন পর্যন্ত আসেনি কোনো সরকারি-বেসরকারি ত্রান। এনিয়ে মানুষের বাড়ছে দুর্ভোগ, ক্ষোভ ও  অনেক জনপ্রতিনিধিও ক্ষুব্ধ।
কুশিয়ারা নদীর পানি কমলেও বিয়ানীবাজার উপজেলার ৭ ইউনিয়ন পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বিয়ানীবাজার পৌরসভার অধিকাংশ এলাকা। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। গবাদি পশুও নিরাপদ স্থানে সরাচ্ছেন কবলিত এলাকার বাসিন্দারা। গতকাল শুক্রবারও সিলেটের সাথে বিয়ানীবাজারের সরাসরি যোগযোগ বন্ধ রয়েছে।
কুশিয়ারা নদীর পানি বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে দুই পয়েন্ট কমে বিপদ সীমার ২১ পয়েন্টের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট-বিয়ানীবাজার আঞ্চলিক মহাসড়কের আরও বেশ কিছু অংশ তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে সিলেটের সাথে যোগাযোগের বিকল্প সড়ক বিয়ানীবাজার-চন্দরপুর সড়কের আশি ভাগ অংশ। বিয়ানীবাজার উপজেলার ৭ ইউনিয়ন ও পৌরসভা পরিদর্শন করেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আতাউর রহমান খান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মু: আসাদুজ্জামান ও পৌর মেয়র আব্দুস শুকুর।
এদিকে বন্যার প্রভাব পড়েছে সবজি বাজারে। গতকাল শুক্রবার বিয়ানীবাজার পৌরশহরে কেজি প্রতি ২০ টাকা থেকে ৩-০ টাকা বেড়েছে। গতকাল ঢেড়শ ৫০ টাকা, ঝিংগা  ৬০ টাকা, বরবটি ৬৫ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বন্যা যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় সবজির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান। দাম বেড়েছে মাছ ও বয়লার মুরগির।
বন্যা কবলিত এলাকার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে সাড়ে ১৪ টন ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিয়ানীবাজার উপজেলা প্রশাসনের কাছে এ ত্রাণ দু’একদিনের মধ্যে এসে পৌছাবে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মু: আসাদুজ্জামান।
সরেজমিন বন্যা কবলিত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দুবাগ, শেওলা, কুড়ারবাজার, মাথিউরা, তিলপাড়া, লাউতা, মুড়িয়া ও বিয়ানীবাজার পৌরসভার ৮০ভাগ এলাকার মানুষ পানি বন্ধি হয়ে পড়েছেন। এসব ইউনিয়নের রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গেছে। বাসা-বাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করা মানুষজন আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। গবাদি পশুগুলো উঁচু স্থানসহ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে নিয়ে রাখা হচ্ছে।
খাড়াভরা এলাকার বন্যা কবলিত শফিক উদ্দিন বলেন, নদীর পানি তোড়ের ঘর ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রতিবেশির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। বন্যায় ৭ ইউনিয়ন ও পৌররসভার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দুবাগ, শেওলা, লাউতা ও তিলপাড়া ইউনিয়নের অধিবাসীরা।
এদিকে বৃহস্পতিবার  থেকে সিলেট-বিয়ানীবাজার আঞ্চলিক মহসড়কের যান চলাচল প্রায় বন্ধ । দূরপাল্লার বাস ও মাল বোঝাই ট্রাক সীমিত আকারে চলাচল করেছে। সড়কের বেশ কিছু অংশ পানিতে তলিয়ে যাওয়া অটোরিক্সা, মাইক্রো চলাচল করেনি। এতে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রি। সড়কের ডুবে যাওয়া অংশ মানুষজন টেক্ট্রর ও পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে দেখা গেছে।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আতাউর রহমান খান বলেন, বন্যার পরিস্থিতি দু-একদিনের মধ্যে উন্নতি হবে বলে আমাদের আশা। এরই মধ্যে নদীর পানি কমতে শুরু করেছে।
তিনি আরোও বলেন, সরকারি ত্রাণ সামগ্রি শনিবারের মধ্যে পৌছে যাবে। আমরা চেষ্টা করবো দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে এসব ত্রাণ পৌছে দেয়ার। তিনি সকলের সহযোগিতায় কামনা করেন।